
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বর্তমান চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানকে অপসারণের দাবিতে চলমান আন্দোলন নতুন মাত্রা পেয়েছে। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ বুধবার (২৫ জুন) আগারগাঁওয়ের রাজস্ব ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ঘোষণা দিয়েছে, ২৭ জুনের মধ্যে তাদের দাবি মেনে নেয়া না হলে আগামী ২৮ জুন থেকে ‘মার্চ টু এনবিআর’ নামে নতুন একটি কর্মসূচি শুরু করবে তারা। এই কর্মসূচির মাধ্যমে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে সহস্র কর্মীদের পদযাত্রা (মার্চ) আয়োজন করা হবে এবং এনবিআরের প্রধান কার্যালয়ে জমায়েত হবে বিক্ষোভকারীরা।
এটাই এনবিআরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আন্দোলন হিসেবে ধরা হচ্ছে, যার ফলে দেশের রাজস্ব সংগ্রহ ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম বিপর্যস্ত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে ।
নতুন এই কর্মসূচির ঘোষণা আসায় এনবিআরের কর্মকর্তারা সরকারের সঙ্গে যে কোনও ধরনের আলোচনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ তাদের বক্তব্যে বর্তমান চেয়ারম্যানকে ‘আওয়ামী লীগ সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী’ ও ‘দেশ ও রাজস্ব ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টাকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে পরিষদের সভাপতি হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার ও মহাসচিব সেহেলা সিদ্দিকা জানান, "আমরা দাবি জানাচ্ছি, ২৭ জুনের মধ্যে যদি আমাদের দাবিগুলো মেনে নেওয়া না হয়, তাহলে ২৮ জুন থেকে লাগাতার ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির পাশাপাশি দেশের সব দপ্তর থেকে রাজধানীর রাজস্ব ভবনে পদযাত্রা করা হবে।"
এই কর্মসূচির আগে, গত ২৩ জুন রাজস্ব ভবনে সহস্রাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী তিন ঘণ্টার জন্য কলমবিরতিতে অংশগ্রহণ করেন। কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া অনেক কর্মী কাফনের কাপড় পরে অবস্থান নিয়েছিলেন, যা আন্দোলনের তীব্রতা ও সংকটের প্রতীক হিসেবে প্রকাশ পায়।
সেদিন সংবাদ সম্মেলনের পর ঐক্য পরিষদের নেতারা হ্যান্ড মাইকে বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন পুলিশ তাঁদের বাধা দেয়। কিন্তু আন্দোলনকারীরা পুলিশি এই বাধাকে বেআইনি ঘোষণা করে গণগ্রেপ্তারের জন্য তাদের আহ্বান জানান।
চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবির পাশাপাশি সম্প্রতি এনবিআরের আয়কর অনুবিভাগের পাঁচ কর্মকর্তাকে বিধিবহির্ভূতভাবে বদলি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা বদলির জন্য ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের মৌখিক নির্দেশনা প্রদানের কথাও আন্দোলনকারীরা তুলে ধরেছেন।
এই বদলির আদেশগুলোকে তারা ‘প্রতিহিংসামূলক’ ও ‘নিপীড়নমূলক’ আখ্যায়িত করে প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছেন। এসব ঘটনাই তাদের আন্দোলনের উত্তপ্ততা বাড়িয়েছে এবং সরকারের ওপর চাপ তৈরি করছে।
চলতি বছরের গত মাসে এনবিআরকে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগে ভাগ করে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও নীতি শাখায় বিভাজনের জন্য অধ্যাদেশ জারি করা হয়। যদিও সরকার পরে এই অধ্যাদেশ বাতিল করার আশ্বাস দেয় এবং কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করার প্রতিশ্রুতি দেয়।
এনবিআর কর্মকর্তারা অধ্যাদেশ বাতিলের পাশাপাশি এনবিআর চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে অটল থাকেন। এমনকি তাঁকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করে অফিসের বাইরে তাড়িয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটে। পরবর্তীতে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে অফিসে ফিরতে হয় চেয়ারম্যানকে।
এই দীর্ঘ আন্দোলন ও সাম্প্রতিক ‘মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচির কারণে দেশের কর আদায় ও আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে ব্যাপক ব্যাঘাত সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কর ও কাস্টমস বিভাগে অচলাবস্থার কারণে ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণ গুরুতর সমস্যায় পড়ছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের নীতি-পরিকল্পনায় কোনো পরিবর্তন না আসলে জাতীয় রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকেও হুমকির মুখে ফেলবে।
সরকারি পক্ষ থেকে এখনও আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে এনবিআর ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সূত্র বলছে, আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে। আরেকদিকে আন্দোলনকারীরা তাদের অবস্থানে অটল থেকে নতুন কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের দাবি আদায় করার পরিকল্পনা করছে।
রাজস্ব ভবনের সামনে থেকে শুরু হতে যাওয়া ‘মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচি এবং পরবর্তী ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ দেশের অর্থনীতির জন্য এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত বহন করছে। এনবিআরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের জন্য এখনই প্রয়োজন সংযম ও যুক্তিসংগত সমাধানের সন্ধান। না হলে চলমান বিরোধে দেশের অর্থনৈতিক চাকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ