
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চলমান আন্দোলনের পেছনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কার সুবিধাভোগী কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর ‘স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইন্ধন’ থাকতে পারে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। বুধবার (২৫ জুন) সচিবালয়ে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এই বক্তব্য দেন।
সরকারের পক্ষ থেকে এনবিআরকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটিকে দুটি পৃথক শাখায় ভাগ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে—একটি হবে রাজস্ব আদায় কেন্দ্রিক শাখা, অন্যটি নীতিনির্ধারণী শাখা। মূলত এই সংস্কার উদ্যোগের পরপরই এনবিআরের বিসিএস (কর) এবং বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি) ক্যাডারের কর্মকর্তারা আন্দোলনে নেমেছেন। তাদের দাবি, প্রস্তাবিত এই বিভাজনের ফলে প্রশাসন ক্যাডারের প্রভাব অনেক বেড়ে যাবে এবং এনবিআরে কর্মরত কর-কর্মকর্তাদের ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এই দাবিকে কেন্দ্র করেই গত এক সপ্তাহ ধরে আগারগাঁওয়ের এনবিআরের প্রধান কার্যালয়ে বিক্ষোভ, কলমবিরতি ও কর্মস্থলে অনুপস্থিতি চলমান রয়েছে। সচিব পদমর্যাদার এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান—যিনি প্রশাসন ক্যাডার থেকে এসেছেন—প্রতিদিনই পুলিশ পাহারায় অফিস করছেন। এনবিআরের মতো গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে এমন অচলাবস্থা নজিরবিহীন বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করছেন, এনবিআর সংস্কার একটি প্রয়োজনীয় এবং দীর্ঘদিন ধরে পুঞ্জীভূত সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ। এটি কর্মকর্তাদের ক্যারিয়ারে কোনোভাবেই ক্ষতিকর হবে না বরং উল্টো তারা আরও সুবিধাজনক অবস্থানে যাবেন বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, “এনবিআর কর্মকর্তাদের ক্যারিয়ার নিয়ে একটা নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করা হয়েছে। অথচ বাস্তবে, এই সংস্কার হলে এনবিআর আরও শক্তিশালী একটি স্বাধীন ডিভিশনে রূপ নেবে। এতে তাদের মর্যাদা, দায়িত্ব, প্রমোশন—সব কিছুতেই উন্নতি হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাদেরকে কে কী বুঝিয়েছে? কে তাদের উদ্বুদ্ধ করছে এমন কর্মসূচিতে যেতে? ভেতরের অনেক কিছু আপনারা সাংবাদিকরাই ভালো জানেন।”
এনবিআরের অভ্যন্তরীণ অসঙ্গতি ও জবাবদিহিতার অভাব দূর করতেই এই সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানান অর্থ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, “পূর্বের সরকারের আমলে কিছু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত সুবিধা পেত, অথচ অনেক সৎ ও পরিশ্রমী ব্যবসায়ী বঞ্চিত হতো। এই বৈষম্য দূর করে একটি ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করতেই এই উদ্যোগ। এনবিআরে আগের মতো অস্বচ্ছতা, পক্ষপাত, অনিয়ম এখন আর চলবে না—এই বার্তা সরকার দিচ্ছে।”
এই প্রেক্ষাপটেই অর্থ উপদেষ্টা সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, “আমি সরাসরি কোনো অভিযোগ করছি না, তবে আমি অনুমান করতে পারি যে, এখানে কিছু ব্যবসায়ী তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য আন্দোলনের পেছনে ইন্ধন জোগাচ্ছে। না হলে হঠাৎ করে এত বড় কর্মবিরতি, বিক্ষোভ—এসব কেন? কেবল ক্যারিয়ার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তো এত তীব্র প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা নয়। এর পেছনে অন্য কিছু থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”
সরকারি চাকরিতে শৃঙ্খলার গুরুত্ব তুলে ধরে সালেহউদ্দিন বলেন, “সরকারি কর্মচারী হিসেবে শৃঙ্খলা মানা, নিয়ম মেনে চলা বাধ্যতামূলক। কর্মস্থলে অনুপস্থিতি—বিশেষ করে রাজস্ব খাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে—এই ধরনের ঘটনা অতীতে কখনো দেখা যায়নি। এটা দুঃখজনক। দেশের অর্থনীতি, আমদানি-রপ্তানি, বন্দর ব্যবস্থাপনা—সবকিছুই এনবিআরের কার্যক্রমের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এখানে অচলাবস্থা মানেই জাতীয় ক্ষতি। এমন কোনো সমস্যা নেই যেটা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যাবে না।”
তিনি আরও বলেন, “চাকরি করতে হলে বিধিনিষেধ মানতেই হবে। এটা কারও ব্যক্তিগত ইস্যু নয়—পুরো দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ইস্যু।”
বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন, এই আন্দোলন কেবল প্রশাসন বনাম কর-ক্যাডার দ্বন্দ্ব নয়; বরং এর গভীরে রয়েছে অতীতের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, সুবিধাবাদ, ও ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের প্রভাব। বহু বছর ধরে এনবিআর একটি ‘নিজস্ব বলয়ের’ মধ্যে পরিচালিত হয়ে আসছিল, যেখানে জবাবদিহিতা কিংবা আধুনিক ব্যবস্থাপনার অভাব ছিল প্রকট। বর্তমান সরকার এই বলয় ভাঙার চেষ্টাতেই সরব হয়েছে।
তবে এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের আন্দোলন পেশাগত নিরাপত্তা ও আত্মমর্যাদার প্রশ্নে। তাদের দাবি, প্রশাসন ক্যাডারের আধিপত্য বিস্তারের পরিকল্পনা দীর্ঘমেয়াদে এনবিআরকে দুর্বল করে দেবে।
সবশেষে অর্থ উপদেষ্টা সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে আলোচনার টেবিলে বসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “সরকারের উদ্দেশ্য কোনো পক্ষকে হেয় করা নয়, বরং এনবিআরকে একটি কার্যকর ও স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। আন্দোলন ও অচলাবস্থা কোনো সমাধান নয়। আলোচনার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।”
এনবিআরে চলমান আন্দোলন ও এর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট এখন জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রে। সরকার সংস্কারের পক্ষেই রয়েছে, তবে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—কাদের স্বার্থে এই সংস্কারে বাধা আসছে? অর্থ উপদেষ্টার বক্তব্য অন্তত এই ইঙ্গিতই দিচ্ছে যে, পেছনে সক্রিয় কোনো প্রভাবশালী হাত আছে, যাদের লক্ষ্য ব্যক্তিগত লাভ রক্ষা করা—রাষ্ট্রীয় স্বার্থ নয়।
বাংলাবার্তা/এসজে