
ছবি: সংগৃহীত
‘মব জাস্টিস’ বা জনরোষের নামে হিংস্র উন্মাদনা এখন মানবতার ভয়াবহ শত্রুতে রূপ নিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক নির্যাতনবিরোধী দিবস (২৬ জুন) উপলক্ষে বুধবার (২৫ জুন) গণমাধ্যমে পাঠানো এক দীর্ঘ বিবৃতিতে তিনি এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, এটি কেবল আইনের শাসনের পরিপন্থী নয়, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পথেও বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তারেক রহমানের এই বিবৃতিতে উঠে এসেছে বিশ্ব রাজনীতি, ইতিহাস, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং রাষ্ট্রীয় দমননীতির নানা দিক। নির্যাতনবিরোধী আন্তর্জাতিক এই দিনে বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের প্রতি সহমর্মিতা জানানোর পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংকট, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান।
তারেক রহমান বলেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ববাসী ভেবেছিল, মানবতা এবার মুক্তি পাবে। স্বাধীনতার আলোয় উদ্ভাসিত হবে পরাধীন জাতিগোষ্ঠী। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বরং নতুন নতুন চেহারায় দমন-পীড়ন, সহিংসতা ও রক্তপাত অব্যাহত রয়েছে। একদিকে কিছু দেশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শিকার, অন্যদিকে অনেক দেশ নিজস্ব স্বৈরাচারী শাসকের দমননীতিতে জর্জরিত।”
তিনি বলেন, “বিভিন্ন দেশে একনায়কদের দোর্দণ্ড প্রতাপে বিরোধী মতের মানুষদের গুম, খুন, নির্যাতন এবং মিথ্যা মামলায় বছরের পর বছর কারাবন্দি করে রাখা হচ্ছে। অনেক দেশে বিরোধীদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হামলা চালিয়ে মানুষের জীবন হরণ করছে। নিরীহ নাগরিকদের ওপর চালানো এসব দমন-পীড়ন মানবতার ইতিহাসে এক ভয়ঙ্কর কলঙ্কচিহ্ন হয়ে রয়েছে।”
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তারেক রহমান বলেন, “প্রায় ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশে চলছে এক অঘোষিত রাজনৈতিক দুঃশাসন। আওয়ামী ফ্যাসিবাদী আমলে দেশটি রূপ নিয়েছে এক সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নানা কালাকানুনে শৃঙ্খলিত হয়েছে। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী ও গণতন্ত্রের প্রতীক খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় কারাবন্দি করে রাখা হয়েছে। এমনকি তার চিকিৎসাকেও নানাভাবে বাধা দেওয়া হয়েছে। এটাই ছিল রাষ্ট্রীয় বর্বরতার নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশ।”
তিনি বলেন, “গণতান্ত্রিক চর্চা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিকে কঠোর হাতে দমন করা হয়েছে। ‘অসহিষ্ণুতা’ শব্দটি যেন রাষ্ট্রযন্ত্রের আচরণবিধির অংশ হয়ে গেছে। যেকোনো ভিন্নমত প্রকাশ করলেই লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে দলীয় সন্ত্রাসী বাহিনী ও পেটোয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এভাবে জাতির সমস্ত প্রাণশক্তিকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মানুষ ভয়, শঙ্কা ও নীরবতায় বন্দি হয়ে আছে।”
তারেক রহমান বলেন, “এই ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার সুযোগে দেশে এখন ‘মব জাস্টিস’-এর নামে এক হিংস্র উন্মাদনা গড়ে উঠেছে। অপরাধের বিচার আইনের মাধ্যমে না করে জনতাকে উত্তেজিত করে মাটিতে পিটিয়ে হত্যার সংস্কৃতি গড়ে তোলা হচ্ছে। এটি সরাসরি মানবতা, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। এ ধরনের নৃশংসতা আমাদের সভ্যতা ও গণতন্ত্রের বিকাশে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “মব জাস্টিস হলো বিচারহীনতার চূড়ান্ত রূপ। এটি রাষ্ট্রীয় আইন ব্যবস্থার ব্যর্থতাকে উসকে দেয়। মানুষ যখন আইনের ওপর আস্থা হারায়, তখনই আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। ফলে সমাজে নৈরাজ্য বাড়ে, আইনহীনতা নিত্যনৈমিত্তিক হয়। এর ফলে নিরীহরাও অনেক সময় এই উন্মাদনার শিকার হন, যার বহু প্রমাণ আমরা বিগত বছরগুলোতে দেখেছি।”
তারেক রহমান তার বিবৃতিতে বলেন, “নির্যাতনের শিকার মানুষের প্রতি সম্মান, সংহতি ও সহানুভূতির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে জাতিসংঘ ঘোষিত ২৬ জুনের আন্তর্জাতিক নির্যাতনবিরোধী দিবস। এ দিনটি উপলক্ষে আমাদের মনে রাখা জরুরি—মানবাধিকার রক্ষা করা কেবল রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়, প্রতিটি মানুষের একটি নৈতিক দায়। আমরা যদি নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারি, তাহলে একদিন এই অত্যাচারের শিকার আমরাও হতে পারি।”
তিনি বলেন, “এই দিবসের তাৎপর্য অপরিসীম। এর মধ্য দিয়ে আমরা নির্যাতিত, নিপীড়িত, কারাবন্দি এবং গুম-খুনের শিকার মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ পাই। আমরা তাদেরকে স্মরণ করি, সম্মান জানাই এবং প্রতিজ্ঞা করি—এই দমন-পীড়নের চক্র ভাঙতেই হবে।”
তারেক রহমান তার বিবৃতির শেষে বলেন, “ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্ত হলেও বাংলাদেশে এখনো গণতন্ত্রের প্রকৃত চর্চা শুরু হয়নি। গণতন্ত্র মানে কেবল ভোটের অধিকার নয়, গণতন্ত্র মানে প্রতিটি মানুষের চিন্তা, মত, ভাষা ও জীবনধারার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। এর জন্য শুধু সরকার পরিবর্তন যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। একমাত্র সেদিকেই সমাজে মানবিকতা, সহমর্মিতা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।”
তিনি আহ্বান জানান, “গণতন্ত্রকামী, মানবতাবাদী এবং অধিকারকেন্দ্রিক সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কারণ, এই ঐক্যের মাধ্যমেই আমরা স্বৈরাচার, নিপীড়ন ও নিষ্ঠুরতা পরাস্ত করতে পারব।”
তারেক রহমানের এই বিবৃতিটি শুধু একটি রাজনৈতিক বার্তা নয়, এটি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার একটি প্রতিচ্ছবি। আন্তর্জাতিক নির্যাতনবিরোধী দিবসের প্রেক্ষিতে এমন একটি শক্তিশালী বার্তা দেশে ও বিদেশে মানবাধিকার এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সচেতন ও সচল মানুষদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ