
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানের অপসারণ ও তাঁকে ঘিরে দেওয়া ‘নিপীড়নমূলক বদলি আদেশ’ বাতিলের দাবিতে টানা দুই দিনের কর্মবিরতিতে অংশ নিয়েছেন এনবিআরের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বুধবার (২৫ জুন) সকাল থেকে শুরু হওয়া এই কর্মসূচি বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) পর্যন্ত চলবে।
সরকারি চাকরির বিধি লঙ্ঘন করে এমন কর্মসূচিতে নামলেও কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা নিরুপায় হয়ে কর্মবিরতির মতো কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আন্দোলনের আয়োজক এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ একে “নিপীড়নের বিরুদ্ধে ন্যায্য প্রতিবাদ” হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
বুধবার দুপুরে আগারগাঁওয়ের এনবিআর ভবনে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, অফিসের নিচতলায় ভিড় করে বসে আছেন ট্যাক্স, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে তাঁরা কলমবিরতিতে অংশ নিয়েছেন এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবেই রাজস্ব ভবনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন।
দপ্তরের কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। কেউ ফাইল চালাচ্ছেন না, কোনো সভা-সমাবেশ হচ্ছে না, এমনকি ফোনেও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সাড়া দিচ্ছেন না বলে জানান কয়েকজন সেবা প্রত্যাশী। বহু ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ কর সংক্রান্ত কাজে এসে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। বিভিন্ন বিভাগে অলস সময় কাটাতে দেখা গেছে উপস্থিত কর্মীদের।
ঢাকার বাইরে বিভিন্ন খণ্ড-স্ব দপ্তরেও একইভাবে কর্মকর্তারা অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। শুধু আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা ও রফতানি কার্যক্রম এই কর্মসূচির আওতার বাইরে রয়েছে। অন্য সব শাখায় কার্যত দাপ্তরিক অচলাবস্থা বিরাজ করছে।
মঙ্গলবার (২৪ জুন) এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ আগারগাঁওয়ে এনবিআর ভবনে এক সংবাদ সম্মেলন করে এই কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। সংবাদ সম্মেলনে তাঁরা অভিযোগ করেন, “এনবিআরের বর্তমান চেয়ারম্যান সাবেক পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছেন। তিনি সেই berüchtigt ৪৪ আমলার একজন, যাঁদের মধ্যে ছয়জনকে ইতোমধ্যে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। এমন একজনকে এনবিআরের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে রাখা অর্থনীতির জন্য হুমকি।”
প্রতিনিধিত্বশীল ফোরামটি জানায়, “এই চেয়ারম্যান দেশ ও রাজস্ব ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। তিনি এনবিআরের পেশাগত ঐতিহ্য, কর-কর্মকর্তাদের সম্মান ও স্বাধীনতা নষ্ট করছেন। এই পরিস্থিতিতে তাকে অপসারণের কোনো বিকল্প নেই।”
সংবাদ সম্মেলনে পরিষদের নেতারা বলেন, “যদি ২৭ জুনের মধ্যে এনবিআর চেয়ারম্যানকে অপসারণ করা না হয়, তবে ২৮ জুন থেকে দেশজুড়ে কর, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের সকল দপ্তরে লাগাতার ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি শুরু হবে। আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা ছাড়া আর কোনো দপ্তরে কাজ হবে না। এটাই হবে সর্বশেষ হুঁশিয়ারি।”
এই সময় কর্মকর্তারা নানাভাবে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করছেন। এনবিআরের ভেতরে-পৃথকভাবে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে চলছে নীরব আলোচনাও। কেউ কেউ অভিযোগ করছেন, বর্তমান চেয়ারম্যান সরকারের প্রশাসন ক্যাডার থেকে আসায় দীর্ঘদিনের কাঠামোগত ভারসাম্য ভেঙে পড়েছে এবং কর-কাস্টমস ক্যাডাররা অবমূল্যায়নের শিকার হচ্ছেন।
দুই দিনের কর্মসূচির মধ্যে শুধু কলমবিরতি বা অবস্থান নয়, চলছে ‘ঘৃণা কর্মসূচি’ও। আন্দোলনকারীরা তাদের ভাষায় চেয়ারম্যান ও তার ‘তীর দোসরদের’ প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করছেন। এনবিআর ভবনের বিভিন্ন প্রান্তে কার্টুন, প্ল্যাকার্ড, ব্যানারে সেসব প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পাচ্ছে।
আন্দোলনকারী এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এটি কোনো ব্যক্তিগত আন্দোলন নয়। এনবিআর একটি স্বায়ত্তশাসিত ও পেশাদার প্রতিষ্ঠান ছিল, কিন্তু এখন প্রশাসন ক্যাডারের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে এটিকে দুর্বল করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে মুখ বন্ধ রাখা মানে আত্মসমর্পণ।”
এক কাস্টমস সহকারী কমিশনার বলেন, “আমরা চাই, আমাদের ক্যাডারের মর্যাদা, স্বাতন্ত্র্যতা এবং স্বাধীনতা বজায় থাকুক। এটা রক্ষা না হলে এনবিআরের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।”
অন্যদিকে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছেন, “আমরা এখনও ধৈর্য্য ধরছি। কিন্তু এটা তো স্পষ্ট যে চাকরি করতে হলে বিধিনিষেধ মানতেই হবে। আন্দোলন-অবস্থান এসব করতে গেলে সরকারি শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। এনবিআরের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এই অচলাবস্থা কাম্য নয়।”
তিনি আরও বলেন, “সরকার সংস্কার করতে চায়, এতে কারও ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বরং আরও উন্নতি হবে। তবুও যদি এমন প্রতিক্রিয়া আসে, তাহলে বুঝতে হবে, এর পেছনে অন্য কোনো ইন্ধন রয়েছে।”
দুই দিনের এই কর্মসূচি শেষ হলেও আন্দোলনের মাত্রা এখন ক্রমেই বাড়ছে। এনবিআর কর্মকর্তাদের মধ্যে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ একটি বড় পরিণতির দিকে যাচ্ছে বলে আভাস মিলছে। সরকারের পক্ষ থেকে যদি ২৭ জুনের মধ্যে কোনো উদ্যোগ নেওয়া না হয়, তাহলে ২৮ জুন থেকে যেই ‘কমপ্লিট শাটডাউন’-এর ঘোষণা এসেছে, তা শুধু এনবিআর নয়, বরং জাতীয় রাজস্ব ব্যবস্থাকেই এক বড় চ্যালেঞ্জে ফেলে দেবে। আর এর দায়ভার কতটা আন্দোলনকারীদের, কতটা সরকারের, সেটি সময়ই বলে দেবে।
বাংলাবার্তা/এসজে