
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবারও ২৭ বিলিয়ন ডলারের গণ্ডি পেরিয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ ছাড়ের ফলে মঙ্গলবার (২৫ জুন) বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান সংবাদমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, আইএমএফের বোর্ড সোমবার (২৪ জুন) বাংলাদেশের জন্য চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির ঋণ ছাড়ের অনুমোদন দেয়, যার মোট পরিমাণ ৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১.৩ বিলিয়ন ডলার তাৎক্ষণিকভাবে ছাড় হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রেকর্ড অনুযায়ী, ২৩ জুন পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার মোট মজুত ছিল ২৬ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার (গ্রস)। বিপিএম৬ পদ্ধতিতে হিসাব করলে তা ছিল ২১ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। এর আগে, ১৫ জুন পর্যন্ত রিজার্ভ ছিল ২৬ দশমিক ১৫ বিলিয়ন (গ্রস) এবং ২০ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন (বিপিএম৬)।
মাত্র এক মাস আগে, ২৭ মে পর্যন্ত রিজার্ভ ছিল ২৫ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার (গ্রস), বিপিএম৬ অনুযায়ী ছিল ২০ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। ফলে জুন মাসে রিজার্ভ বৃদ্ধির ধারা স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
২০২২ সালে বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে ৪.৭০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্যাকেজের আবেদন করে। এ ঋণের আওতায় বিভিন্ন পর্যায়ে কিস্তিতে অর্থ ছাড় হচ্ছে। গত বছরের জানুয়ারিতে প্রথম কিস্তি এবং এর পর ধাপে ধাপে দ্বিতীয় ও তৃতীয় কিস্তি ছাড় হয়। এবার একসঙ্গে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি ছাড় হয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সহায়তা বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান বৈদেশিক লেনদেন ঘাটতি, আমদানি ব্যয়, ডলার সংকট ও ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপে থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এই রিজার্ভ বৃদ্ধি একটি বড় আশার আলো দেখাচ্ছে।
২০০৮-০৯ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ৭ বিলিয়ন ডলারের মতো। ২০১৩ সালের জুনে এটি দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলারে। এরপর ধীরে ধীরে রিজার্ভ বাড়তে থাকে।
২০১৮ সালে: রিজার্ভ পৌঁছায় ৩৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়নে
২০২০ সালের সেপ্টেম্বর: ৩৯ বিলিয়ন ডলার
২০২০ সালের অক্টোবর: প্রথমবার ৪০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম
২০২১ সালের ২৪ আগস্ট: ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৪৮ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায় রিজার্ভ
তবে ২০২২ সালের পর বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ চাপ—বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সংকট, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, রেমিট্যান্সে স্থবিরতা ও রপ্তানি আয় হ্রাসের কারণে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমতে শুরু করে।
বিশ্বব্যাপী গৃহীত আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে, একটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় সমান হওয়া উচিত। বাংলাদেশে বর্তমানে মাসিক আমদানি ব্যয় প্রায় ৭ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে কমপক্ষে ২৪ বিলিয়ন ডলারের মতো রিজার্ভ থাকা দরকার।
বর্তমানে গ্রস রিজার্ভ ২৭ দশমিক ৩১ বিলিয়ন হলেও, আইএমএফ অনুমোদিত বিপিএম৬ পদ্ধতিতে তা এখনো ২২ বিলিয়নের কাছাকাছি। ফলে সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে বলেই মত বিশ্লেষকদের।
অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান বলেন, “আইএমএফ থেকে প্রাপ্ত অর্থ স্বল্পমেয়াদে স্বস্তি দিলেও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়। রপ্তানি আয়ে গতি ফেরানো, প্রবাসী আয় বাড়ানো এবং অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিয়ন্ত্রণ না করলে এই রিজার্ভ আবার হ্রাস পেতে পারে।”
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, তারা এখন রিজার্ভ রক্ষা ও পুনরুদ্ধারে তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে:
রেমিট্যান্স হুন্ডি প্রতিরোধ করে বৈধ চ্যানেলে আনার প্রচেষ্টা
ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা
আর্থিক খাতের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে বিদেশি সহায়তা ও বিনিয়োগ আকর্ষণ করা
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, “আমরা শুধু রিজার্ভের অঙ্ক বাড়াতে নয়, এর গুণগত মান ও টেকসইতা নিশ্চিত করতে চাই। যেসব ঋণ বা সহায়তা এসেছে, তা যাতে উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় হয়, সেটাই এখন মূল লক্ষ্য।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ