
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলার প্রতিক্রিয়ায় হরমুজ প্রণালি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইরান। এর ফলে শুধু আন্তর্জাতিক জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থাই নয়, বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর অর্থনীতির দেশগুলো ভয়াবহ সংকটে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও নীতিনির্ধারকেরা। দেশের আমদানি-রপ্তানি, জ্বালানি সরবরাহ, মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ—সবকিছুর ওপর পড়বে গভীর প্রভাব। বিশেষ করে চলমান মধ্যপ্রাচ্য সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে এই নেতিবাচক প্রভাব আরও তীব্র হতে পারে বলে মত বিশ্লেষকদের।
ইসরাইল-ইরান চলমান যুদ্ধের মধ্যে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলা চালায়। এর জবাবে রবিবার ইরানের পার্লামেন্ট হরমুজ প্রণালি বন্ধের সিদ্ধান্ত পাস করে। যদিও এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি, তবে পার্লামেন্টে আইন পাস হওয়ার পর বিষয়টি কেবল সময়ের ব্যাপার বলে মনে করা হচ্ছে। প্রণালিটি আন্তর্জাতিকভাবে খনিজ তেল পরিবহণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পথ হিসেবে পরিচিত। দৈনিক প্রায় ২ কোটির বেশি ব্যারেল তেল এই পথ দিয়ে সরবরাহ হয়, যা বিশ্ব সরবরাহের ২০ শতাংশ এবং এশিয়ার ৮০ শতাংশ জ্বালানি তেলের উৎস।
বাংলাদেশের আমদানির প্রায় ৩০ শতাংশই আসে তিনটি খাতে—জ্বালানি, খাদ্য এবং সার। এর বড় অংশ হরমুজ প্রণালির ওপর নির্ভরশীল। ফলে এটি বন্ধ হলে সরবরাহ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা জ্বালানি সংকট, মূল্যস্ফীতি এবং আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক ঢেউ তুলবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “হরমুজ প্রণালি জ্বালানি ও অন্যান্য আমদানির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নৌরুট। এটি বন্ধ হলে আমাদের জাহাজগুলোকে দীর্ঘপথ ঘুরে আসতে হবে, এতে সময় এবং পরিবহণ খরচ দুই-ই বহুগুণ বেড়ে যাবে। ফলে সামগ্রিক আমদানি ব্যয় এবং বাজারে পণ্যের মূল্য বাড়বে।”
তিনি আরও বলেন, “এর প্রভাব কেবল জ্বালানির ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। পরিবহণ ব্যয় বৃদ্ধির কারণে তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য রপ্তানি পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধাও হারাতে পারে বাংলাদেশ। এছাড়া জাহাজ সংকটের কারণে আমদানি প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হবে।”
ড. মোস্তাফিজুর আরও মনে করেন, এই পরিস্থিতির আরও একটি গুরুতর দিক হচ্ছে রেমিট্যান্স। তিনি বলেন, “যুদ্ধ যদি আরও বিস্তৃত হয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হয়, তাহলে আমাদের প্রবাসী আয়ে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রক্ষায় বড় ভূমিকা রাখে। এটি কমে গেলে আমদানি সক্ষমতা, মুদ্রা বিনিময় হার ও সামগ্রিক মূল্যস্ফীতিতে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, “যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশে প্রধানত দুটি খাতে বড় প্রভাব পড়বে। প্রথমত, জ্বালানি তেলের দাম বাড়বে, যা শিল্প ও পরিবহণ খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। দ্বিতীয়ত, মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি অবনত হলে সেখানে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের আয় হ্রাস পাবে, রেমিট্যান্স কমবে। এই দুইয়ের সম্মিলিত চাপ দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে দুর্বল করে ফেলবে।”
অন্যদিকে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক এম কে মুজেরী বলেন, “বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন একান্তভাবেই রেমিট্যান্স এবং আমদানিকৃত জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে এ দুটি খাতেই ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হবে। এর প্রভাব শুধু জ্বালানির দামে সীমাবদ্ধ থাকবে না—শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হবে, বৈদেশিক বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাকফুটে চলে যাবে।”
তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, “বাংলাদেশের জ্বালানির একটি বড় অংশ আসে কাতার ও ওমান থেকে। হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে সরাসরি জ্বালানি সংকট সৃষ্টি হবে। অন্য পথে জ্বালানি আমদানি করতে হলে খরচ অনেক বেড়ে যাবে এবং সময়ও বেশি লাগবে।”
তিনি বলেন, “এই সংকট কেবল অভ্যন্তরীণ চাহিদার ক্ষেত্রেই নয়, বৈদেশিক বাণিজ্যেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারণ, বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে পণ্যের দাম বাড়বে, ক্রয়ক্ষমতা কমবে, রপ্তানি বাজার সঙ্কুচিত হবে। এতে আমাদের তৈরি পোশাক শিল্প, যা জিডিপির বড় অংশ জুড়ে আছে, সেটিও বিপদে পড়বে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই পরিস্থিতি মোকাবিলায় জরুরি প্রস্তুতি নিতে হবে। যেমন—
বিকল্প জ্বালানি সরবরাহ চ্যানেল তৈরির জন্য আগেভাগেই কূটনৈতিক যোগাযোগ ও বাণিজ্যিক চুক্তি করতে হবে।
জাহাজ সংকট এড়াতে আগেভাগেই শিপিং লাইনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ এবং সমন্বয় জরুরি।
রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় কৌশল নিতে হবে, যাতে আমদানি খাতে ধাক্কা কম পড়ে।
জ্বালানি সাশ্রয় ও বিকল্প উৎসের (পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানি) ওপর জোর দিতে হবে।
প্রবাসী আয়ের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে শ্রমবাজার কূটনীতি জোরদার করতে হবে।
পরিস্থিতি এখনও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে না গেলেও, হরমুজ প্রণালি বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা এবং মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের বিস্তার—উভয়ই বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বড় শঙ্কা হয়ে দেখা দিয়েছে। একটি সংকট থেকে যেন আরেকটি সংকটে জড়িয়ে না পড়ে, সেজন্য সরকার, ব্যবসায়িক সংগঠন এবং সংশ্লিষ্ট মহলকে সমন্বিতভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। সময় থাকতেই প্রস্তুতি না নিলে সামনে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি আসতে পারে, তা মোকাবিলা করা কঠিন হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ