
ছবি: সংগৃহীত
মাঠে লড়াইয়ের আগে মাঠের বাইরেই তৈরি হয়েছে বিতর্ক। এএফসি উইমেন্স এশিয়ান কাপ ২০২৬-এর বাছাইপর্ব খেলতে মিয়ানমার যাচ্ছে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। আসন্ন এই গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক আসরের জন্য মঙ্গলবার (২৪ জুন) চূড়ান্ত ২৩ সদস্যের স্কোয়াড ঘোষণা করেন দলের প্রধান কোচ পিটার বাটলার। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে ফুটবলের চেয়ে বেশি আলোচনায় ছিল টানা দুই সাফজয়ী অধিনায়ক সাবিনা খাতুন ও দলের অভিজ্ঞ দুই খেলোয়াড় মাসুরা পারভীন ও সানজিদা আক্তারকে বাদ দেওয়া।
এতদিন ধরে যাঁরা ছিলেন বাংলাদেশের নারী ফুটবলের মুখ, তাঁদের ছাড়া দল গঠন করা এবং এই বিষয়ে জবাব এড়িয়ে যাওয়াটা একটি বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে ক্রীড়ামহলে। সাবিনার মতো একজন তারকা ফুটবলারকে কেন স্কোয়াডে রাখা হলো না, সেটি জানতে চাওয়ায় সংবাদ সম্মেলনের আবহ মুহূর্তেই বদলে যায়।
বাংলাদেশ নারী দলের নতুন অধিনায়ক আফঈদা খন্দকারকে যখন সাংবাদিকরা সরাসরি সাবিনা-মাসুরাদের অনুপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন করেন, তখন তিনি হালকা হাসির সঙ্গে মাত্র দুটি শব্দে উত্তর দেন: “নো কমেন্টস।” বিষয়টি নিয়ে আর কিছু না বলে প্রশ্ন পাশ কাটিয়ে যান তিনি।
তাঁর এই সংক্ষিপ্ত জবাবে খুশি হয়ে উঠেন কোচ পিটার বাটলার। সংবাদ সম্মেলনের মাঝখানেই অধিনায়কের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেন, “এই কক্ষে কিছু লোক বিতর্ক পছন্দ করে, পুরনো গল্প টেনে আনে। এটা একজন তরুণী খেলোয়াড়কে জিজ্ঞেস করার মতো প্রশ্ন নয়। এমন প্রশ্ন থাকলে আমার কাছে করুন। কিন্তু আমার জবাবও একই—নো কমেন্টস।”
পরবর্তীতে একই প্রশ্ন পুনরায় বাটলারকে করা হলে তিনি আরেকটু খোলামেলা হলেও নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। বলেন, “আপনারা উমেলা মারমাকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন করছেন না। অথচ সে একজন বিস্ময়কর প্রতিভা। ওর মতো ট্যালেন্ট আমি এই ফেডারেশনে খুব কম দেখেছি। তাই আমি বলছি—পুরোনোদের নিয়ে পড়ে থাকবেন না, নতুনদের দিকে তাকান।”
তিনি আরও যোগ করেন, “আমি যাদের নির্বাচন করেছি, তারা আমার মতে সেরা ২৩ জন। তারা এই আসরে ভালো কিছু করার সামর্থ্য রাখে। আমি প্রত্যেককে তাদের সাম্প্রতিক ফর্ম, অনুশীলনের মান ও ট্যাকটিক্যাল পরিকল্পনার আলোকে নির্বাচন করেছি। যারা বাদ পড়েছে, তাদের সম্মান করি, তবে এখন আমার চোখ শুধুই ভবিষ্যতের দিকে।”
সাবিনা খাতুন, যিনি জাতীয় দলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং গত এক দশকে নারী ফুটবলের আইকন, তাঁর অনুপস্থিতি প্রশ্ন তুলেছে অনেকের মধ্যে। জাতীয় দলে তাঁর ভূমিকা শুধু মাঠেই নয়, দলের মনোবলে, মিডিয়া ব্যবস্থাপনায় ও ভক্তদের সঙ্গে সংযোগ তৈরিতেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তার বাদ পড়া যে শুধুই পারফরম্যান্সের কারণে, তা অনেকেই মানতে নারাজ।
সাবিনার ঘনিষ্ঠ এক সূত্র বলেছে, সাম্প্রতিক সময়ে তিনি জাতীয় দল নিয়ে কিছু অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন এবং কোচের সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা টানাপড়েনে রয়েছে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে কেউই তা স্বীকার করেননি।
শুধু সাবিনা নয়, দলের দুই অভিজ্ঞ সদস্য—ডিফেন্ডার মাসুরা পারভীন ও ফরোয়ার্ড সানজিদা আক্তারকেও দেখা যাবে না এই দলে। এই তিনজনই নারী ফুটবলের সাফল্যের পরতে পরতে জড়িয়ে থাকা নাম। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই তিনজনের অনুপস্থিতি একদিকে যেমন তরুণদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে, অন্যদিকে অভিজ্ঞতার ঘাটতি দলকে চাপে ফেলতে পারে।
দলে আছেন একঝাঁক তরুণ ও প্রতিভাবান খেলোয়াড়। বিশেষ করে উমেলা মারমা-কে ঘিরেই তৈরি হয়েছে নতুন প্রত্যাশা। কোচ বাটলারের ভাষায়, “এই বয়সে ওর মতো গেম রিডিং, স্পিড ও ডিসিপ্লিন আমি খুব কম খেলোয়াড়ের মধ্যে দেখেছি। তাকে নিয়ে আমার আলাদা পরিকল্পনা আছে।”
বাংলাদেশের ২৩ সদস্যের এই স্কোয়াডে রুপনা চাকমা, মারিয়া মান্দা, মনিকা চাকমা, তহুরা খাতুন, শামসুন্নাহার জুনিয়র—এর মতো নির্ভরযোগ্য নাম থাকলেও অভিজ্ঞতার জায়গায় একধরনের শূন্যতা থেকে যাচ্ছে।
চূড়ান্ত স্কোয়াড (২৩ জন)
গোলরক্ষক: রুপনা চাকমা, মিলি আক্তার, স্বর্ণা রানী
ডিফেন্ডার: শিউলি আজিম, শামসুন্নাহার (সিনিয়র), আফঈদা খন্দকার, জয়নব বিবি, নিলুফা ইয়াসমিন
মিডফিল্ডার: মনিকা চাকমা, মারিয়া মান্দা, মুনকি আক্তার, ঋতুপর্ণা চাকমা, সুরভী আকন্দ
ফরোয়ার্ড: তহুরা খাতুন, শামসুন্নাহার (জুনিয়র), কোহাতি কিসকু, স্বপ্না রানী, মোসাম্মত সাগরিকা, শাহেদা আক্তার, হালিমা আক্তার, মোসাম্মত সুলতানা, নবীরণ খাতুন, উমেলা মারমা
সাবিনাদের না থাকা, ‘নো কমেন্টস’ কৌশল এবং নতুনদের উপর আস্থার এই কাহিনি বাংলাদেশের নারী ফুটবলের একটি নতুন অধ্যায় হতে চলেছে। তবে অভিজ্ঞদের অনুপস্থিতি কি তরুণদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে? নাকি ঠিক এই জায়গা থেকেই জন্ম নেবে নতুন এক সাফল্যের গল্প?
উত্তর দেবে মাঠের খেলা। কিন্তু এই দল ঘোষণা এবং সংবাদ সম্মেলনের ভাষ্য ঠিকই বলছে—বাংলাদেশ নারী ফুটবলে শুরু হয়েছে এক নতুন অধ্যায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ