
ছবি: সংগৃহীত
গল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম তুলে ফেলেছেন নাজমুল হোসেন শান্ত। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চলমান টেস্টে দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরি করে শুধু দলের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে নেতৃত্ব দেননি, বরং গড়েছেন এক অনন্য রেকর্ড। বাংলাদেশ টেস্ট দলের অধিনায়ক হিসেবে তিনি প্রথমবারের মতো এক ম্যাচেই জোড়া সেঞ্চুরি করলেন। বিশ্ব ক্রিকেট ইতিহাসে অধিনায়ক হিসেবে এই বিরল কীর্তি গড়লেন মাত্র ১৬তম খেলোয়াড় হিসেবে।
তবে নিজের এই রেকর্ড নিয়ে বিন্দুমাত্র গর্ব বা চিৎকার নেই শান্তর কণ্ঠে। ম্যাচশেষে যখন সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করেন, তখন বিস্ময় নিয়ে তিনি বলেন, “আমি জানতাম না যে আমি বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়ক হিসেবে এক টেস্টে দুই সেঞ্চুরি করেছি। অবশ্যই ভালো লাগছে দলের কাজে লাগতে পেরে।”
২০২৩ সালের নভেম্বরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করার পর থেকে লাল বলের ক্রিকেটে ফর্মহীনতা পিছু ছাড়ছিল না শান্তর। এমনকি চলতি বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের বিপক্ষেও বড় ইনিংস খেলতে পারেননি তিনি। কিন্তু গলে এসে সেই অতীত যেন ছাইচাপা আগুনের মতো জ্বলে উঠেছে।
প্রথম ইনিংসে শান্ত খেলেন ১৪৮ রানের চোখধাঁধানো এক ইনিংস। টাইগাররা যখন ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে (৪৫/৩), তখন মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে চতুর্থ উইকেটে ২৬৪ রানের এক মহামূল্যবান জুটি গড়েন তিনি। শান্তর ইনিংসটি ছিল কৌশলী, ধৈর্যশীল এবং সুসংহত। শরীরের কাছাকাছি বল খেলা, অফ স্টাম্পের বাইরের বল ছাড়ার মতো ব্যাটিংয়ের প্রাথমিক পাঠ আবারও যেন স্মরণ করিয়ে দিলেন তিনি।
সেই ইনিংসই ছিল বাংলাদেশের জন্য প্রথম ইনিংসে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার বড় সুযোগ। বড় সংগ্রহের ভিত পায় দল।
গল টেস্টে দ্বিতীয় ইনিংসেও শান্ত ছিলেন অবিচল। এবার তিনি অপরাজিত থাকেন ১২৫ রানে। টাইগাররা যখন দ্বিতীয় ইনিংসে চাপ অনুভব করছে, তখন আবারও সামনে এগিয়ে এসে দলের ব্যাটিং হাল ধরেন শান্ত। উইকেট যখন একের পর এক পড়ছে, তিনি তখন একপ্রকার একাই ব্যাটিংয়ের বোঝা কাঁধে নেন। তার ইনিংসটি ছিল বেশি রক্ষণাত্মক, তবে পরিস্থিতির দাবি মেটাতেই এমন ব্যাটিং করেছেন তিনি।
এই ইনিংসেই বাংলাদেশ লঙ্কানদের সামনে ৩৭৫ রানের এক চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্য দাঁড় করাতে সক্ষম হয়, যদিও ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত ড্রতে গড়ায়।
২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে শান্তর ব্যাটে ছিল না কোনো সেঞ্চুরি। ফর্মহীনতা নিয়ে সমালোচনা চলছিল অনেকদিন। অনেকেই প্রশ্ন তুলছিলেন তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে। কিন্তু গলের এই ম্যাচ দিয়ে যেন শান্ত দিয়েছেন সেসব সমালোচনার উত্তর। সাদা পোশাকে টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে ফর্মে ফেরা, জোড়া সেঞ্চুরি—সবমিলিয়ে এক পরিপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের গল্প।
বিশ্ব টেস্ট ক্রিকেটে অধিনায়ক হিসেবে এক ম্যাচে দুই সেঞ্চুরি করাটা একান্তই একটি বিরল ঘটনা। এখন পর্যন্ত মাত্র ১৬ জন অধিনায়ক এই কীর্তি গড়েছেন। আর বাংলাদেশ দলে পুরো টেস্ট ইতিহাসে এমন কীর্তি গড়েছেন কেবল তিনজন ব্যাটার—মুমিনুল হক, তামিম ইকবাল এবং এখন নাজমুল হোসেন শান্ত। কিন্তু তাদের কেউই অধিনায়ক হিসেবে এই কীর্তি গড়েননি।
শান্তর এই কীর্তিতে প্রশংসা করেছেন সতীর্থ মুশফিকুর রহিমও। তিনি বলেন, “এই ইনিংসগুলো শুধু রান নয়, এটা দলের জন্য নেতৃত্বের বার্তা। যেভাবে চাপের মুখে ব্যাটিং করেছে শান্ত, সেটা যেকোনো অধিনায়কের জন্য অনুকরণীয়।”
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পক্ষ থেকেও টুইটারে পোস্ট করে শান্তর প্রশংসা করা হয়েছে।
টেস্ট ম্যাচটি ড্র হলেও নাজমুল হোসেন শান্তর জন্য এটি হতে পারে একটি মাইলফলক মুহূর্ত। ব্যাট হাতে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন, নেতৃত্বেও দেখিয়েছেন স্থিরতা। এখন দেখার বিষয়, এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে শান্ত কিভাবে ভবিষ্যতের কঠিন সফরগুলোতে দলকে টেনে নিয়ে যান।
সর্বোপরি, গল টেস্টে শান্তর ব্যাটিং শুধুমাত্র পরিসংখ্যান বাড়ায়নি, বরং বাংলাদেশ ক্রিকেটকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে— একজন শান্তই হঠাৎ করে কতটা ঝড় তুলতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ