
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ধীরে ধীরে দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদের দিকে এগোচ্ছে। যদিও এটি আগামী সংসদ থেকে শুরু হবে নাকি পরবর্তী সংসদ থেকে—এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে রাজনৈতিক দলগুলো নীতিগতভাবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের পক্ষে একমত প্রকাশ করেছে। শিগগিরই অনুষ্ঠিতব্য জুলাই সনদে এই বিষয়টি স্থান পাবে এবং দেশের সব প্রধান রাজনৈতিক দলের স্বাক্ষর অন্তর্ভুক্ত থাকবে। তাই এ সনদকে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি অঙ্গীকার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ কী?
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ হচ্ছে এমন একটি আইনসভা যেখানে দুটি পৃথক কক্ষ থাকে—একটি হলো উচ্চকক্ষ, অন্যটি হলো নিম্নকক্ষ। এতে আইন প্রণয়নে ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ বা ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করা হয়। সাধারণত, নিম্নকক্ষের সদস্যরা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন এবং তারা মূলত আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু কোনো আইন কার্যকর করতে হলে উচ্চকক্ষের অনুমোদন নিতে হয়। এই ব্যবস্থা আইন প্রণয়নের স্বচ্ছতা ও সমতা নিশ্চিত করে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা ও দলগুলোর মতামত
রাষ্ট্রসংস্কার নিয়ে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের আলোচনায় দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ এবং উচ্চকক্ষের ১০০ আসনের কাঠামো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। তবে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন ও নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে কিছু বিতর্ক রয়েছে। চলতি সপ্তাহের আলোচনায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের ব্যাপারে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল একমত হলেও নীতিগতভাবে কিছু দল আপত্তি জানিয়েছে। তবুও অধিকাংশ দল ১০০ আসনের উচ্চকক্ষ গঠনের পক্ষে মত দিয়েছেন।”
বিএনপি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট, এনডিএমসহ কিছু দল উচ্চকক্ষের আসন নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে নির্বাচনের পক্ষে। অন্যদিকে এনসিপি, গণসংহতি আন্দোলন, জেএসডি, গণঅধিকার পরিষদসহ অনেক দল সংখ্যালঘু নির্বাচনের পদ্ধতিতে ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টনের পক্ষে মত দিয়েছে। জামায়াত উভয় কক্ষকেই সংখ্যালঘু নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, “আমাদের দলের পক্ষে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের ধারণাটি বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও বিভিন্ন সেক্টরের বিশিষ্ট নাগরিকদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে পিআর (প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে আসন) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের নির্বাচনের বিষয়ে আমরা আপাতত একমত নই।”
উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব ও পদ্ধতি
সংবিধান সংস্কার কমিটির খসড়া প্রস্তাবে উল্লেখ আছে, নিম্নকক্ষ হবে ৪০০ আসনের, যেখানে সদস্যরা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। আর উচ্চকক্ষে থাকবে ১০৫ আসন। এই উচ্চকক্ষের ১০০ আসন হবে ভোটের অনুপাতে রাজনৈতিক দলগুলোকে বরাদ্দ দেওয়া হবে। বাকি ৫টি আসনে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হবে।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান বলেন, “সংসদের উভয় কক্ষে ভোটের অনুপাতে নির্বাচনের পক্ষে আমরা অবস্থান নিয়েছি।” এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাভেদ রাসিন ও দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসানত আবদুল্লাহও ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষ আসনের বণ্টনের পক্ষে মত দিয়েছেন।
সংসদ সচিবালয়ের প্রস্তুতি
সংসদ সচিবালয় ইতোমধ্যেই দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের জন্য প্রাথমিক অবকাঠামোগত পরিকল্পনা শুরু করেছে। সংসদ ভবনের ক্যাবিনেট কক্ষকে উচ্চকক্ষ হিসেবে তৈরি করার প্রাথমিক ভাবনা চলছে। বিকল্প হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বা শপথ কক্ষকেও উচ্চকক্ষ বানানোর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে অধিবেশনের জন্য ব্যবহৃত মূল কক্ষটি নিম্নকক্ষ হিসেবে থাকবে।
সুপারিশ অনুযায়ী, নিম্নকক্ষের আসন সংখ্যা হবে ৪০০, যা বর্তমানে ৩৫৪ আসনের চেয়ে বেশি। অধিবেশন কক্ষে থাকা কূটনীতিক ও বিদেশি অতিথিদের জন্য সংরক্ষিত দুটি লাউঞ্জও নিম্নকক্ষের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
বর্তমান এককক্ষীয় সংসদ ও ভবিষ্যতের পরিবর্তন
বর্তমানে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ এককক্ষবিশিষ্ট, যার মোট আসন সংখ্যা ৩৫০টি। এর মধ্যে ৩০০ আসন সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত, আর ৫০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত। এই আসনগুলি প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে বিতরণ করা হয়।
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে আরো শক্তিশালী করা হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। উচ্চকক্ষের মাধ্যমে বিশিষ্ট সমাজকর্মী, শিক্ষাবিদ ও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে একটি ভারসাম্যমূলক আইনসভা গঠন সম্ভব হবে।
আগামীদিনে বাংলাদেশে দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনকে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। জুলাই সনদে দলগুলোর অংশগ্রহণ এবং সমঝোতার ভিত্তিতে এটি বাস্তবায়ন হলে দেশের গণতন্ত্রের আরো বিকাশ ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ