
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের বিচার বিভাগে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা আজও অপূর্ণ। মাসদার হোসেন মামলার রায়ের ২৬ বছর পেরিয়ে গেলেও বিচার বিভাগ পৃথকীকরণসংক্রান্ত আপিল বিভাগের ১২ দফা নির্দেশনার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি। এরই ধারাবাহিকতায় বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠনের দাবি ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছে। সুপ্রিমকোর্ট এই পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য সরাসরি সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে আজ (২২ জুন) ঢাকায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সেমিনার, যার শিরোনাম ‘বিচারিক স্বাধীনতা ও দক্ষতা’। সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ এই সেমিনারকে "টার্নিং পয়েন্ট" হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার মতে, সেমিনারের পর বিচার বিভাগের কাঠামোগত দিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হবে। সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে, আজকের সেমিনারেই প্রধান উপদেষ্টা বিচারে স্বাধীনতা ও কাঠামোগত সংস্কারের বিষয়ে বড় কোনো ঘোষণা দিতে পারেন।
১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর দেশের আপিল বিভাগ ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলায় ১২ দফা নির্দেশনাসহ রায় দেন। ওই রায়ে বলা হয়, বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে সম্পূর্ণভাবে পৃথক করতে হবে। কিন্তু ২০০৭ সালে আংশিক পৃথকীকরণের পরও বহু নির্দেশনা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এর অন্যতম হলো—সুপ্রিমকোর্টের জন্য পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা। বর্তমানে বিচার বিভাগের প্রশাসনিক ও কাঠামোগত কার্যক্রমে আইন মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ রয়ে গেছে, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিচার বিভাগের অনেকেই মনে করেন, এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে জনগণের আস্থা ফিরে আসবে না। সুপ্রিমকোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ এখতিয়ার বিচারকদের পদোন্নতি, বদলি, ছুটি, শৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তকে দ্বৈত শাসনের আওতায় ফেলে দিয়েছে।
২০২৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ শপথ গ্রহণের পর প্রথম অভিভাষণে বিচার বিভাগের জন্য একটি সংস্কার রোডম্যাপ উপস্থাপন করেন। সেখানে তিনি বলেন, “বিচার বিভাগের মূল দায়িত্ব হলো—নিরপেক্ষভাবে, স্বল্প সময় ও খরচে বিরোধের মীমাংসা করে সমাজ, রাষ্ট্র ও জনগণকে সুরক্ষা দেওয়া। এজন্য বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা থেকে পৃথক ও স্বাধীন করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “আইনের শাসন নিশ্চিত করাই বিচার বিভাগের লক্ষ্য। বিচারকদের প্রকৃত স্বাধীনতা তখনই আসবে, যখন আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথ এখতিয়ার বাতিল করে সুপ্রিমকোর্টের অধীনে একটি পৃথক সচিবালয় গঠিত হবে।” সেই ঘোষণার পর ১০ মাস অতিক্রান্ত হলেও এখনো সেই সচিবালয় প্রতিষ্ঠার দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি।
সুপ্রিমকোর্টের পাবলিক রিলেশন অফিসার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠনের লক্ষ্যে সুপ্রিমকোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিদের মতামত নিয়ে একটি প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। প্রস্তাবটি গত বছরের ২৭ অক্টোবর আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। তবে মন্ত্রণালয়ে এখনো এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্যায়ে রয়েছে। ফলে কাজটি এগিয়ে যাচ্ছে ধীরগতিতে।
তিনি জানান, প্রধান বিচারপতি সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেছেন, “রোববারের সেমিনারটি হবে আমাদের জন্য একটি মোড় পরিবর্তনের মুহূর্ত। আশাবাদী, এখান থেকে সুখবর আসতে পারে।”
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হলে অধস্তন আদালতের বিচারকদের পদায়ন, বদলি, পদোন্নতি, শৃঙ্খলা, ছুটি ইত্যাদি বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে দায়িত্ব পালন করবে সুপ্রিমকোর্ট। এতে করে বহুল আলোচিত দ্বৈত শাসনের অবসান হবে এবং বিচার বিভাগ প্রশাসনিকভাবে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে।
সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, “মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। এখনো বিচারকদের পদোন্নতি, বদলি ইত্যাদি বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় কর্তৃত্ব করছে, যা স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার পরিপন্থী।” তিনি বলেন, “একটি সত্যিকারের স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য সুপ্রিমকোর্টের অধীন একটি পূর্ণাঙ্গ সচিবালয় গঠন অত্যাবশ্যক।”
বর্তমানে বিচার বিভাগের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো মামলাজট। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ১৭ বছর পরও মামলাজট তিন গুণ বেড়েছে। বহু বিচারপ্রার্থী বছরের পর বছর ধরে বিচারের অপেক্ষায় দিন কাটান। বিচার বিভাগীয় সংস্কারের ক্ষেত্রে এই ব্যর্থতা জনগণের মধ্যে বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থার সংকট তৈরি করেছে। সুপ্রিমকোর্ট মনে করছে, একটি স্বাধীন সচিবালয় গঠনের মাধ্যমে এই পরিস্থিতির বড় একটি অংশ মোকাবিলা করা সম্ভব।
আজকের সেমিনারকে ঘিরে বিচার বিভাগীয় মহলে ব্যাপক আশাবাদ বিরাজ করছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস যদি আজ পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা দেন, তাহলে এটি হবে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পূর্ণ বাস্তবায়নের পথে বড় অগ্রগতি। এটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, দক্ষতা এবং জনআস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক হতে পারে।
বিচার বিভাগের কাঠামোগত সংস্কারে আজকের দিনটি আদৌ টার্নিং পয়েন্ট হয়ে ওঠে কি না, এখন তাকিয়ে রয়েছে গোটা জাতি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ