
ছবি: সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলায় গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) ট্রাইব্যুনাল এক আদেশে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ ওয়াই মশিউজ্জামানকে অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ এই আদেশ দেন।
এই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে আইনগত মতামত প্রদান এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করাই হবে অ্যামিকাস কিউরির মূল দায়িত্ব। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৪১ ধারার অধীনে এই নিয়োগ দেওয়া হয়, যেখানে বলা আছে, আদালত চাইলে এক বা একাধিক অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ করতে পারে, যদি তারা মনে করে, মামলার ন্যায্য নিষ্পত্তিতে নিরপেক্ষ মতামত প্রয়োজন।
বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় ট্রাইব্যুনাল কার্যক্রম শুরু হলে প্রসিকিউশন পক্ষ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চলমান আদালত অবমাননার মামলার অগ্রগতির বিষয়টি আদালতকে অবহিত করে। তখন ট্রাইব্যুনাল অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে এবং প্রসিকিউশনকে মতামত দিতে বলে।
প্রসিকিউটর গাজী এম এস তামিম আদালতকে জানান, “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী, আদালত ৪১ ধারার আওতায় অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দিতে পারেন। মামলার গুরুতরতা এবং রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা বিবেচনায় এটি ন্যায়বিচার নিশ্চিতের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।”
এই যুক্তির ভিত্তিতে আদালত সাবেক অ্যাটর্নি এ ওয়াই মশিউজ্জামানকে এই দায়িত্বে নিয়োগ দেন। আগামী ২৫ জুন অ্যামিকাস কিউরির বক্তব্য শুনবে ট্রাইব্যুনাল।
এই মামলার সূত্রপাত ঘটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি বিতর্কিত অডিও ক্লিপকে কেন্দ্র করে। সেখানে এক নারীকণ্ঠকে বলতে শোনা যায়, "২২৭ জনকে হত্যার লাইসেন্স পেয়ে গেছি"। তদন্তকারী সংস্থার ফরেনসিক বিশ্লেষণে এটি শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর বলে শনাক্ত করা হয়েছে। ফরেনসিক পরীক্ষার ফল ট্রাইব্যুনালের সামনে উপস্থাপন করা হলে বিষয়টি গুরুতর আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে বলে অভিহিত করা হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে, ৩০ এপ্রিল শুনানিতে ট্রাইব্যুনাল দুইজন আসামিকে ২৫ মে তারিখে সশরীরে হাজির হয়ে ওই অডিও বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলে।
তবে নির্ধারিত দিনে আসামিরা হাজির হননি এবং আইনজীবীর মাধ্যমেও কোনো ব্যাখ্যা দেননি। এই অবস্থায় ট্রাইব্যুনাল কড়া অবস্থান গ্রহণ করে এবং দুই আসামিকে সশরীরে হাজির হয়ে অভিযোগের বিষয়ে জবাব দেওয়ার জন্য সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেয়। পরদিন দুটি জাতীয় দৈনিকে ওই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, ৩ জুন এর মধ্যে আসামিদের হাজির হয়ে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করতে হবে।
তবে গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ওই অডিও ক্লিপের সত্যতা ও প্রেক্ষাপট নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অডিওর উৎস, প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ ছাড়া এমন একটি মামলা রাজনৈতিক পরিবেশকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে এ ওয়াই মশিউজ্জামানের নিয়োগ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি একজন খ্যাতনামা আইনজীবী হিসেবে সুপরিচিত, যিনি অতীতে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মামলায় আদালতকে সহায়তা করেছেন নিরপেক্ষ মতামতের মাধ্যমে।
আইন বিশ্লেষকদের মতে, অ্যামিকাস কিউরির দায়িত্ব হলো আদালতকে মামলার সার্বিক প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করা, পক্ষ-বিপক্ষের বাইরে থেকে আইনি দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা, যাতে আদালত বিচারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে আরও সুপরিকল্পিত ও ন্যায়নিষ্ঠ হতে পারে। বিশেষ করে যেখানে রাষ্ট্রের সাবেক প্রধান নির্বাহীর বিরুদ্ধে এমন সংবেদনশীল অভিযোগ থাকে, সেখানে এই ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চলমান এই মামলা শুধু একটি আদালত অবমাননার অভিযোগ নয়, বরং এর রাজনৈতিক অভিঘাত রয়েছে বহুমাত্রিক। ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার পর থেকে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ ও মামলা চলছে, যা তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ও দলের অবস্থানকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
বিভিন্ন মহল থেকে এই মামলাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেও অভিহিত করা হচ্ছে। আবার অপরপক্ষ বলছে, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়—প্রধানমন্ত্রী হলেও নয়।
শেখ হাসিনার আদালত অবমাননার মামলায় অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিচারিক ধাপে প্রবেশ করলো। আগামী ২৫ জুন অ্যামিকাস কিউরির বক্তব্য আদালতে উপস্থাপিত হলে মামলার গতিপথ নির্ধারণে নতুন মোড় আসতে পারে।
এই মামলার পরিণতি শুধু একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ভবিষ্যৎ নয়, বরং দেশের আইন ও বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা এবং স্বাধীনতার বিষয়েও বড় প্রশ্ন উত্থাপন করবে। এখন দেখার বিষয়—আইনের ভাষা, তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা, এবং বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতায় কীভাবে প্রতিফলিত হয় দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ