
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে দীর্ঘদিনের উত্তেজনা এবার সরাসরি সামরিক সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে—এমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক এবং বর্তমান প্রেসিডেন্টদের মধ্যে সবচেয়ে অনিশ্চিত এবং ধ্রুবপদহীন সিদ্ধান্তের জন্য পরিচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প এবার ইরানে সম্ভাব্য সামরিক হামলার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছেন বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।
তবে এখনো পর্যন্ত এই অনুমোদন চূড়ান্ত নির্দেশে রূপ নেয়নি। অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শেষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ইরানের পক্ষ থেকে কোনো কূটনৈতিক সমঝোতা আসে কি না, সেটাই এখন দেখছেন বলে হোয়াইট হাউস সূত্র জানিয়েছে।
গত সপ্তাহে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, “আমি (হামলা) করতেও পারি, নাও করতে পারি।” তার এই দ্ব্যর্থবাক্যের মধ্যেই বিশ্লেষকরা দেখছেন হুমকি, কূটনৈতিক চাপ এবং সম্ভাব্য বিস্ফোরক সংঘাতের ইঙ্গিত।
ট্রাম্প আরও বলেন, “আগামী সপ্তাহটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে যাচ্ছে, এমনকি পুরো সপ্তাহও লাগবে না—এর আগেই সবকিছু ঘটে যেতে পারে।” তার এই মন্তব্যের পরপরই আন্তর্জাতিক পরিসরে শুরু হয়েছে উত্তেজনা ও উদ্বেগের নতুন তরঙ্গ।
দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলছে, ট্রাম্প প্রশাসনের টার্গেটে রয়েছে ইরানের ফোর্দো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র। ইরানের কেন্দ্রীয় পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত এই কেন্দ্রটি ভূগর্ভস্থ এবং চরম নিরাপত্তার আওতায় রক্ষিত।
সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, এই কেন্দ্র ধ্বংস করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী 'বাংকার-বাস্টার' বোমা ব্যবহার করতে হবে, যেটি ভূগর্ভস্থ লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা।
এই লক্ষ্যবস্তু বেছে নেওয়ার পেছনে যুক্তি হলো—এটি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির অন্যতম কেন্দ্রস্থল এবং এর ধ্বংস মানে হবে তেহরানের বড় ধাক্কা।
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এরইমধ্যে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, তার দেশ কখনোই আত্মসমর্পণ করবে না এবং যুক্তরাষ্ট্র যদি হামলার পথে এগোয়, তবে তার চরম মূল্য দিতে হবে।
খামেনি বলেন, “ইরানকে ঘায়েল করা সহজ নয়। আমরা আমাদের মাটি রক্ষা করব—যেকোনো মূল্যে।”
এই বক্তব্যের পর ইরান নিজেও প্রস্তুতি বাড়িয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটি এবং সীমান্ত এলাকায় ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডসহ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটকে সর্বোচ্চ সতর্কতায় রাখা হয়েছে।
ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে উল্লেখযোগ্য সামরিক প্রস্তুতি নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর তৃতীয় একটি ডেস্ট্রয়ার মোতায়েন করা হয়েছে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে। এছাড়া একটি এয়ারক্রাফ্ট ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ আরব সাগরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
যদিও পেন্টাগন দাবি করেছে, এসব মোতায়েন প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে নেওয়া হয়েছে, তবে সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি মূলত সম্ভাব্য হামলার ক্ষেত্র প্রস্তুতের কৌশল। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে, ইরানকে চাপ দিয়ে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, যেখানে তারা হয় আত্মসমর্পণ করবে, অথবা একটি সীমিত সামরিক অভিযানকে সহ্য করতে বাধ্য হবে।
বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, ট্রাম্প প্রশাসন এই অভিযান চালালে তা এককভাবে নয়, বরং ইসরাইলের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে হতে পারে। কারণ ইসরাইল নিজেই বর্তমানে ইরানের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে লিপ্ত।
গত কয়েক সপ্তাহে ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলায় পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়েছে। ইরানে চালানো ইসরাইলি হামলায় এখন পর্যন্ত ৪৫০ জন নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে, ইরানের পাল্টা হামলায় ইসরাইলেও অন্তত ২৪ জন নিহত হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের সংঘর্ষ সামনের দিনগুলোতে আরেকটি বৃহৎ যুদ্ধের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি অংশগ্রহণ করলে গোটা মধ্যপ্রাচ্য অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে।
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এ বিষয়ে। তারা মনে করছে, সামান্য ভুল সিদ্ধান্তই গোটা অঞ্চলকে অনিয়ন্ত্রিত সংঘাতে জড়াতে পারে, যার ফলাফল ভয়াবহ হবে সাধারণ মানুষের জন্য।
বিশ্বজুড়ে তেলবাজার, নিরাপত্তা নীতি, শরণার্থী সংকট—সবকিছুই প্রভাবিত হতে পারে এই এক সিদ্ধান্তের কারণে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইরান নীতি বরাবরই ছিল কঠোর, চাপ প্রয়োগভিত্তিক এবং হঠাৎ হঠাৎ আগ্রাসী। তার প্রেসিডেন্সির দ্বিতীয় দফায় আবারও সেই ধারা দেখা যাচ্ছে।
তবে হামলা হবে কি না, তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও মুলতুবি। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই নীতিগত অনুমোদন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, যা যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যকে।
সামনের কয়েক দিনেই পরিষ্কার হবে—এই উত্তেজনা কূটনীতির পথে গড়াবে, না সামরিক সংঘর্ষের ভয়াল অধ্যায় শুরু হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ