
ছবি: সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার আগুন দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। পাল্টাপাল্টি হামলায় কাঁপছে ইরান ও ইসরাইল। দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান সংঘাত বুধবার (১৮ জুন) রাতভর নতুন মাত্রা পায় যখন ইরান থেকে ব্যাপক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয় তেল আবিবসহ ইসরাইলের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও আবাসিক এলাকাগুলোর ওপর। এদিকে, ইসরায়েলও এর জবাবে ইরানের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে।
এই পাল্টাপাল্টি আক্রমণ শুধু দু’দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বিশ্বশান্তির ওপরই ছায়া ফেলতে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বেগ প্রকাশ করলেও দুই দেশের একরোখা অবস্থান, একে অপরকে দোষারোপ এবং প্রতিশোধের মনোভাব সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে।
তেহরান থেকে পাঠানো ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যাপক আঘাতে আতঙ্কে দিন কাটিয়েছে তেল আবিববাসী। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম দাবি করেছে, তাদের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইসরাইলের উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা Iron Dome–কে ভেদ করে টার্গেটে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে।
তেহরান দাবি করছে, এসব আঘাতে ইসরাইলের বেশ কিছু সামরিক স্থাপনা ও লজিস্টিক সেন্টার ধ্বংস হয়েছে। তবে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী জানিয়েছে, হামলার অনেকটাই তারা প্রতিহত করতে পেরেছে এবং ক্ষয়ক্ষতি সীমিত হয়েছে।
এই হামলার জবাবে ইসরাইলও পাল্টা হামলা চালিয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর বিবৃতি অনুযায়ী, তারা ইরানের বিভিন্ন রকেট লঞ্চার ইউনিট, কমান্ড সেন্টার এবং পারমাণবিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত কিছু স্থাপনায় হামলা করেছে।
আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA) জানিয়েছে, ইরানের দুটি সেন্ট্রিফিউজ উৎপাদন কেন্দ্র আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই আঘাত ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রমে সাময়িক ধাক্কা দিলেও পুরোপুরি অচল করতে পারেনি।
এই সংঘাতের মধ্যে জাতির উদ্দেশে ভিডিও বার্তা দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। তিনি স্পষ্ট করে দেন, ইরান কখনো আত্মসমর্পণ করবে না এবং কেউ তাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে চাইলে তার চরম মূল্য দিতে হবে।
খামেনির ভাষায়, “ইরান কখনোই মাথা নত করবে না। যারা ইরান ও আমাদের জাতিকে চেনে, তারা জানে—এই জাতিকে হুমকি দিয়ে দমিয়ে রাখা যায় না। আমেরিকানদের জানা উচিত, তারা যদি সামরিক হস্তক্ষেপ করে, তা হলে এমন ক্ষতি হবে যা তারা কখনো পূরণ করতে পারবে না।”
তিনি আরও বলেন, ইসরাইল যে ভুল করেছে—ইরানে হামলা চালিয়ে—তার শাস্তি তাকে পেতেই হবে।
এই অবস্থার মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, “ইরান ৬০ দিন সময় পেয়েছিল, কিন্তু তারা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা আত্মসমর্পণ করতে পারত। এখন পরিস্থিতি অন্য পথে যাচ্ছে।”
তবে ইরানে ইসরাইলের পাশে থেকে সামরিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র অংশ নেবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প সরাসরি কোনো ঘোষণা না দিয়ে বলেন, “আমরা এখনো সিদ্ধান্ত নেইনি। তবে সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।”
ট্রাম্প দাবি করেন, ইরানি কর্মকর্তারা ওয়াশিংটনে আলোচনার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। তবে জাতিসংঘে ইরানের স্থায়ী মিশন এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে ট্রাম্পের বক্তব্যকে “মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর” বলে আখ্যা দেয়।
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তায় বলেন, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেকোনো সিদ্ধান্ত নিলেই আমরা তা বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী বর্তমানে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।”
এই বার্তা বুধবার (১৮ জুন) মার্কিন সিনেটের ‘আর্মড ফোর্সেস কমিটি’র এক শুনানিতে তিনি দেন। এতে স্পষ্ট হয় যে, ওয়াশিংটনে যুদ্ধের সম্ভাব্য প্রস্তুতির ছক আঁকা শুরু হয়েছে।
ইরান-ইসরাইল উত্তেজনা বিশ্বশান্তির জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ানোয় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ খুব শিগগিরই একটি জরুরি বৈঠক ডেকেছে। বৈঠকে সদস্য রাষ্ট্রগুলো এই সংকট নিরসনে কী কী কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া যায় তা নিয়ে আলোচনা করবে।
জাতিসংঘ মহাসচিব এক বিবৃতিতে বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতি এক ভয়াবহ সংঘর্ষের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সব পক্ষকে সংযত হতে হবে। যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়।”
বিভিন্ন মহলের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, ইরান ও ইসরাইলের এই উত্তপ্ত অবস্থান যদি দ্রুত থামানো না যায়, তা হলে পুরো মধ্যপ্রাচ্য আরেকটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। এতে কেবল দুটি দেশের ভবিষ্যৎ নয়, গোটা অঞ্চল এবং বিশ্ব অর্থনীতিও চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তারা যদি ইসরাইলের পাশে সরাসরি সামরিকভাবে দাঁড়িয়ে পড়ে, তবে সংঘাত আর সীমিত থাকবে না। পাল্টাপাল্টি হুমকি, প্রতিশোধ ও আন্তর্জাতিক চাপের এই খেলায় এখন বিশ্বের নজর একটি প্রশ্নে—এই আগুন থামবে কীভাবে? শান্তিতে, না যুদ্ধের ঝড়ে?
বাংলাবার্তা/এমএইচ