ছবি: সংগৃহীত
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রচারণার দৃশ্যপটে বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এবার নির্বাচনী প্রচারে বহুল ব্যবহৃত প্রচার মাধ্যম পোস্টার নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। তার পরিবর্তে প্রার্থীরা বিলবোর্ড, ব্যানার, হ্যান্ডবিল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা চালাতে পারবেন। তবে বিদেশি অর্থায়নে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার কার্যক্রম চালানোর ওপর থাকবে কঠোর নিষেধাজ্ঞা।
এই সিদ্ধান্তের কথা বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন ভবনে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানান নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। ব্রিফিংয়ে আরও উপস্থিত ছিলেন নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. আখতার আহমেদ এবং এনআইডি ডিজি এসএম হুমায়ুন কবীর।
নির্বাচন কমিশনার সানাউল্লাহ জানান, কমিশন ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের জন্য প্রণীত ‘আচরণবিধিমালা ২০২৫’-এর খসড়া অনুমোদন করেছে। এই বিধিমালা চূড়ান্তভাবে কার্যকর হবে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের পর। তবে খসড়া অনুযায়ী, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আর পোস্টার ব্যবহার করা যাবে না।
তিনি বলেন, “পরিবেশ রক্ষা ও নগর দৃশ্যদূষণ রোধের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রার্থীরা এখন থেকে বিলবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন, হ্যান্ডবিল এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রচারণা চালাতে পারবেন। তবে সোশ্যাল মিডিয়াতে বিদেশি অর্থায়নে কোনো ধরনের প্রচার অভিযান চলবে না। এটি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ থাকবে এবং ভঙ্গ করলে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
নতুন আচরণবিধিতে ডিজিটাল মাধ্যমকে অনুমোদন দেওয়ার পাশাপাশি এই মাধ্যমগুলোতে প্রচারণা পরিচালনার ক্ষেত্রে সমতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে নানা নিয়ম যুক্ত করা হয়েছে।
সানাউল্লাহ বলেন, “কমিশন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রচারের জন্য একটি নির্দিষ্ট কাঠামো তৈরি করবে। যাতে অর্থবিত্তশালী প্রার্থীরা অন্যদের তুলনায় বাড়তি সুবিধা না পায় এবং সবাই সমান সুযোগ পান।”
এ বিষয়ে ইসি সচিব আখতার আহমেদ বলেন, “সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারের নিয়মকানুন ঠিক করতে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হবে। কমিটি মনিটরিং করবে যাতে কেউ ভুল তথ্য বা গুজব ছড়াতে না পারে, এবং প্রার্থীদের সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়ে জনমত প্রভাবিত করতে না পারে।”
প্রার্থীদের ইশতেহার এবং ভিশন জনগণের সামনে তুলে ধরার জন্য আরেকটি অভিনব ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে ইসি।
কমিশনার বলেন, “প্রতিটি সংসদীয় আসনে রিটার্নিং কর্মকর্তারা একটি ‘কমন প্ল্যাটফর্ম’ তৈরি করবেন। সেখানে সংশ্লিষ্ট আসনের সব প্রার্থী তাঁদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ও পরিকল্পনা তুলে ধরবেন। এটি হবে উন্মুক্ত ও সমতাভিত্তিক আলোচনার জায়গা, যেখানে ভোটাররা সরাসরি প্রার্থীদের বক্তব্য শুনে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।”
এই উদ্যোগের মাধ্যমে প্রচারণা আরও কার্যকর ও যুক্তিসঙ্গত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন নির্বাচন কর্মকর্তারা। এতে করে মিছিল, শোডাউন কিংবা বিভ্রান্তিকর প্রচারের বদলে বিশ্লেষণভিত্তিক প্রচার হোক, সেটিই ইসির লক্ষ্য।
নতুন আচরণবিধিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো:
অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (ভিভিআইপি) উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের আচরণবিধির আওতায় আনা হয়েছে। তারা প্রচারে অংশ নিলে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে।
কোনো ব্যক্তি যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির সভাপতি বা সদস্য হন এবং প্রার্থী হতে চান, তবে তাকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগে উক্ত পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে।
প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষেত্রে আরপিওর ৯১/ঙ ধারা নতুন আচরণবিধিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা নির্বাচনের স্বচ্ছতা বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলেছেন, এই নতুন বিধিমালা মূলত আধুনিক, তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর, পরিবেশবান্ধব এবং ন্যায়ভিত্তিক নির্বাচনী সংস্কৃতির দিকে একটি অগ্রসর পদক্ষেপ।
কমিশনার আবুল ফজল বলেন, “আমরা এমন একটি নির্বাচন চাই, যেখানে পরিবেশ নষ্ট না করে, প্রার্থীরা নিজেদের বক্তব্য জনগণের কাছে তুলে ধরতে পারেন। যেখানে টাকা ও ক্ষমতার দাপট নয়, বরং যুক্তি, নীতি ও ভিশনের মাধ্যমে ভোটারদের আস্থা অর্জন হবে।”
এই খসড়া আচরণবিধি নিয়ে এখনই রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে পোস্টার নিষিদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছু রাজনৈতিক দল উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারে, যাদের মূল প্রচারভিত্তি দীর্ঘদিন ধরেই পোস্টার-নির্ভর। তবে নির্বাচন কমিশন মনে করে, সময় এসেছে প্রচারের ধরন আধুনিক ও পরিচ্ছন্ন করার।
নির্বাচনী পরিবেশে সৌহার্দ্য, শৃঙ্খলা ও নীতির রাজনীতি নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনের এ সিদ্ধান্ত একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সব মিলিয়ে ২০২৫ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে এবার প্রযুক্তি, সমতা এবং পরিবেশ রক্ষার ওপর জোর দিয়ে এগোচ্ছে নির্বাচন কমিশন। এখন দেখার বিষয়, এই নতুন রূপে রাজনৈতিক দলগুলো কতটা প্রস্তুত—আর ভোটাররা কতটা গ্রহণ করেন এই পরিবর্তনকে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



