
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের (Non-Performing Loan বা NPL) অভাবনীয় বড় অংশ ১০টি ব্যাংকে কেন্দ্রীভূত হয়ে রয়েছে। সরকারি এবং বেসরকারি মিলিয়ে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দেশের মোট খেলাপি ঋণের ৭১ শতাংশের বেশি। এতে ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা ভঙ্গুর ও সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে, যা সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে রেকর্ড চার লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকায়। এর মধ্যে মাত্র ১০টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় তিন লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, খেলাপি ঋণের প্রায় তিন চতুর্থাংশই এই সংস্থাগুলোর দায়িত্বে।
সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে অগ্রণী, জনতা, সোনালী এবং রূপালী ব্যাংক খেলাপি ঋণে শীর্ষে অবস্থান করছে। বেসরকারি ও ইসলামী ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং ইউনিয়ন ব্যাংক।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব ব্যাংকে ঋণখেলাপির মূল কারণের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্বল প্রশাসন।
জনতা ব্যাংক দেশের অন্যতম বৃহত্তম খেলাপি ঋণগ্রহীতার তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকটির মোট ঋণ বিতরণ ছিল ৯৪ হাজার ৭৩৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৭০ হাজার ৮৪৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা খেলাপি। মাত্র নয় মাসের মধ্যে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ প্রায় ৪৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
জনতা ব্যাংকের এই ঋণ বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জনপ্রিয়তা পাওয়া বড় শিল্পগোষ্ঠী যেমন অ্যানটেক্স, ক্রিসেন্ট, বেক্সিমকো, থার্মেক্স ও এস আলম গ্রুপের ব্যাপক আর্থিক কেলেঙ্কারি।
দেশের বৃহত্তম শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেড়েই চলেছে। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৭ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৭.৩৮ শতাংশ। বিশেষ উদ্বেগের বিষয়, এই খেলাপি ঋণের অর্ধেকের বেশি নিয়েছে বিতর্কিত এস আলম গ্রুপ এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো।
গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পরিবর্তনের আগে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ৭ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা, যা গত এক বছরের মধ্যে প্রায় ছয় গুণ বেড়েছে।
ইসলামী ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ওমর ফারুক খান জানান, ঋণ আদায়ে ব্যাপক চেষ্টার মধ্যেও বড় ঋণগ্রহীতাদের অসহযোগিতার কারণে আদায় কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। তিনি জানান, গত দুই মাসে এস আলম গ্রুপসহ অনেক বড় ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট আইনে ৩৭০টি ও অর্থঋণ আদালতে ২৪টি মামলা করা হয়েছে।
অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৯ হাজার ৭২০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪১.৩৫ শতাংশ। ব্যাংকটির কর্মকর্তা জানান, রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগুলো বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে প্রশাসনিক জটিলতা সৃষ্টি করেছেন। ঋণ আদায় এখনও সন্তোষজনক পর্যায়ে নয়।
ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২৭ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা, যা ব্যাংকের মোট ঋণের ৬৪ শতাংশ। বিগত ১৬ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সিকদার গ্রুপের প্রভাব ছিল ব্যাংকটির ওপর। রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হন।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণও উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ প্রায় ৯০ শতাংশ, যা অত্যন্ত চিন্তার বিষয়। আইএফআইসি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ মার্চে ২৫ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা, যা গত বছরের জুনে মাত্র ৩৭৫৬ কোটি টাকা ছিল।
ব্যাংকটির কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন, সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ব্যাংকটিকে ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করেছেন।
সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৯ হাজার ৯১ কোটি টাকা এবং রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৭ হাজার ১২২ কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম বলেন, “ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন জরুরি। অন্যথায় ঋণখেলাপির প্রবণতা আরও বাড়বে এবং অন্যরাও উৎসাহিত হবেন।”
অর্থনীতির সুস্থতা রক্ষার জন্য ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণের দ্রুত আদায় নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি দুর্নীতি ও অনিয়মের পুনরাবৃত্তি রোধে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও কঠোর নজরদারি অত্যন্ত প্রয়োজন। সরকারেরও উচিত যথাযথ নীতি ও নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাতে ব্যাংকিং খাতে আর্থিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসে।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে সংকটের মুখে রয়েছে। খেলাপি ঋণের উচ্চমাত্রা এবং বড় ব্যাংকগুলোর আর্থিক দুর্বলতা দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে পারে। তবে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা, সুসংগঠিত ঋণ আদায় পদ্ধতি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব। সময়ও বলবে এই উদ্যোগ কতটা সফল হবে, কিন্তু তা না হলে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ