ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত বর্তমানে এক চরম দুরবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা এখন চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ শেষে দেশের ব্যাংক খাতে শ্রেণিকৃত বা খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাস্তবে এই অঙ্ক আরও অনেক বড় এবং এর জন্য মূলত দায়ী শীর্ষ ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া।
সম্প্রতি কিছু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে কিছুটা আশার সঞ্চার হলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শুধুমাত্র পর্ষদ পরিবর্তনে ব্যাংক খাতের দুর্দশা দূর হবে না। কারণ, শীর্ষ ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, তার কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। অনেক খেলাপি এখনো দেশ ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, কেউ কেউ বিদেশে বসেই লেনদেন চালিয়ে যাচ্ছেন, আবার অনেকেই দেশের ভেতরে নানা রাজনৈতিক সংযোগ কাজে লাগিয়ে আইনের আওতার বাইরে রয়ে গেছেন।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘‘সরকার এখনো শীর্ষ ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। আমার মতে, এখনই একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ ১০ ঋণখেলাপির বিচার করতে হবে। তাদের সম্পদ জব্দ করে, গ্রেফতার করে জেলে পাঠাতে হবে। তারা জেলের ভাত না খেলে শোধরাবে না।’’
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করছেন, চলমান পরিস্থিতিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আগামী সেপ্টেম্বর নাগাদ ৮ লাখ কোটি টাকা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। তাঁর মতে, যেসব ঋণ আগে নানা কৌশলে লুকানো যেত, এখন সেগুলো প্রকাশ্যে চলে এসেছে। এর কারণ, আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির আওতায় খেলাপি ঋণ লুকানোর সুবিধাগুলো সরকার প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে।
তিনি বলেন, “একটা বড় অংশ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। কিছু সম্পদ ইতোমধ্যে উদ্ধার হয়েছে, আরও হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) ও অন্যান্য সংস্থা কাজ করছে। এছাড়া কয়েকজন শীর্ষ ঋণখেলাপি জেলে রয়েছেন, বাকিরা পলাতক।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতে মোট ঋণ ছিল ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। আর একই সময়ে খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকায়, যা ডিসেম্বরের তুলনায় তিন মাসে বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। অথচ ওই সময় ঋণ বেড়েছে মাত্র ৩০ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা।
২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত যেখানে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, সেখানে মাত্র ১৫ মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ লাখ ২০ হাজার কোটিরও বেশি। অর্থাৎ এই সময়কালে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এর বড় অংশই বেড়েছে বেসরকারি ব্যাংক খাতে, যেগুলোর মধ্যে কিছু ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৯৮ শতাংশে পৌঁছেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত সরকার বিভিন্ন রাজনৈতিক বিবেচনায় কিছু ব্যবসায়ীকে অগ্রাধিকার দিয়ে ব্যাংকের অর্থ লুটের সুযোগ করে দিয়েছে। এদের কেউ কেউ সরাসরি কোনো ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণই নিয়ে নিয়েছিল। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ব্যাংকের ভেতরে বসেই নিজেদের পছন্দমতো ঋণ অনুমোদন করিয়ে নিয়েছে তারা। এই অর্থ আর ফেরত আসছে না, বরং পাল্টা হিসেবে নানা রকম আইনি সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে খেলাপিরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার সময় খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এরপর ধাপে ধাপে নানা রকম নীতিসহায়তা দিয়ে এই পরিমাণে বাড়তি সুবিধা দিয়ে পরিস্থিতি আরো নাজুক করে ফেলা হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ঋণ পুনঃতফশিল নীতিতে বিশেষ সুবিধা চালু করা হয়। এরপর থেকে খেলাপিদের ঋণ ফেরত না দিয়েও নিয়মিত দেখানো হতো।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের চাপের মুখে এসব সুবিধা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে সরকার। যেমন—মেয়াদি ঋণ অনাদায়ী থাকার ছয় মাস পর থেকে খেলাপি হিসেবে শ্রেণিকরণ বাধ্যতামূলক করা হয়। ফলে আগের ‘আড়ালে রাখা’ হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ হঠাৎ করেই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এই শুদ্ধি অভিযানের ফলেই বাস্তব চিত্র এখন জনসমক্ষে।
বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের সর্বশেষ রিপোর্টে পাঁচটি কারণে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির বিষয়টি তুলে ধরে। যেমন—
মেয়াদি ঋণখেলাপির সময় পুনর্নির্ধারণ;
ব্যাংক পরিদর্শনের সময় বড় অঙ্কের ঋণ শ্রেণিকৃত হওয়া;
গ্রাহকের চলতি ঋণ নবায়ন না হওয়া;
পুনঃতফশিল করা ঋণের কিস্তি যথাসময়ে না দেওয়া;
সুদ যোগ হয়ে পুরোনো খেলাপি ঋণের অঙ্ক বাড়া।
চলতি বছরের মার্চ শেষে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ২০.১৬ শতাংশ। অন্যদিকে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা (৪৫.৭৯ শতাংশ)। বিশেষায়িত ব্যাংকে ৬ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা (১৪.৪৭ শতাংশ) ও বিদেশি ব্যাংকে ৩ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা (৪.৮৩ শতাংশ) খেলাপি ঋণ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা একমত যে, এখনই যদি শীর্ষ ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে ব্যাংক খাত পুরোপুরি ভেঙে পড়বে। এজন্য তারা নিম্নোক্ত সুপারিশ করেছেন:
বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন: যেখানে প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ ১০ খেলাপির বিচার হবে দ্রুত সময়ে।
সম্পদ জব্দ ও দেশে ফেরত আনার উদ্যোগ জোরদার করা।
আইন সংশোধন করে ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের’ বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া।
দুদকের কার্যক্রম আরও গতিশীল করা।
রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করে সত্যিকার বিচার নিশ্চিতে সরকারের সদিচ্ছা প্রকাশ।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের এখন যে চেহারা, তা কেবল আর্থিক ব্যর্থতা নয়—এটি রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং নীতিনির্ধারণী ব্যর্থতার সমন্বিত ফল। আর এই ব্যর্থতার খেসারত দিচ্ছে পুরো জাতি। এখনই যদি কঠোর এবং সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে এই সংকট শুধু ব্যাংক খাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থার ভিত্তিকেও নড়বড়ে করে তুলবে। তাই সময় এসেছে সত্যিকার প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার। সবচেয়ে বড় প্রয়োজন, আইনের শাসনের আওতায় শীর্ষ খেলাপিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



