
ছবি: সংগৃহীত
বিগত সরকারের সময়ে ভোক্তা অধিকার চরমভাবে অবহেলিত ও খর্ব হয়েছে—এমন মন্তব্য করে অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন বলেছেন, এখন সময় এসেছে ভোক্তার অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং বাজারব্যবস্থায় ন্যায্যতা ফিরিয়ে আনার। বুধবার (১৮ জুন) বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। “ভোক্তা অধিকার কার্যক্রম শক্তিশালীকরণ” শীর্ষক ওই সভার আয়োজন করে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
সভায় সভাপতিত্ব করেন ক্যাবের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জামিল চৌধুরী। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবুর রহমান এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান।
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন বলেন, “গত কয়েক বছর ধরে আমরা দেখেছি, দেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত—বাজার ও বাণিজ্য ব্যবস্থাকে সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি করে ফেলা হয়েছিল। পরিকল্পিতভাবে কিছু গোষ্ঠী ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতার পরিবেশ নষ্ট করেছে, দাম বাড়িয়ে জনগণকে ঠকিয়েছে, এমনকি সুস্থ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের অবশ্যই এই অচলাবস্থার অবসান ঘটাতে হবে। যেসব গোষ্ঠী সিন্ডিকেট গড়ে তুলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছে, তাদের বিরুদ্ধে এখনই সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়তে হবে। একটি দেশের বাজার ব্যবস্থায় ন্যায্যতা না থাকলে সে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে পড়ে। আমাদের লক্ষ্য—ভোক্তার অধিকার সুরক্ষা, বাজারে স্বচ্ছতা, এবং প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ নিশ্চিত করা।”
ভবিষ্যতের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, “আমরা চাচ্ছি বাজারে বৈচিত্র্য আনতে, যাতে প্রতিযোগিতা বাড়ে এবং দাম স্থিতিশীল থাকে। ইতোমধ্যে বাজার মনিটরিংয়ে আমরা নতুন কৌশল নিয়েছি এবং তাতে কিছুটা হলেও স্বস্তি এসেছে। কিন্তু শুধু বাজার পর্যবেক্ষণই যথেষ্ট নয়—আমাদের আরও গভীরভাবে ভাবতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “আজ যদি নীতিগত পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়, তাহলে আমরা সেটা করব। প্রয়োজনে বাণিজ্য নীতি পরিবর্তন করে হলেও ভোক্তার অধিকার নিশ্চিত করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সরকার জনগণের পক্ষের শক্তি হয়ে কাজ করছে—এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষা করাই হবে আমাদের মূল উদ্দেশ্য।”
সভায় বক্তারা বলেন, ভোক্তার অধিকার নিয়ে এতদিন শুধু আলোচনা হয়েছে, বাস্তব প্রতিফলন খুব কম ছিল। এবার সেই ধারা ভাঙতে চায় বর্তমান সরকার। ভোক্তা অধিদফতরকে আরও শক্তিশালী করে সারা দেশে কার্যকরী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হবে।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, “আমরা ভোক্তার স্বার্থে কী করছি, তা দৃশ্যমান করতে হবে। এ দায়িত্ব শুধু ভোক্তা অধিদফতরের নয়, বরং এটি একটি সমন্বিত জাতীয় প্রয়াস হওয়া উচিত।”
ভোক্তা অধিদফতরের মহাপরিচালক আলীম আখতার খান বলেন, “আমরা আইন ও বিধিমালার দিক থেকে অনেক অগ্রসর হয়েছি। কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে আরও সক্রিয় হতে হবে। জনগণের মধ্যে ভোক্তা অধিকার নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে মিডিয়া, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ—সব জায়গায় উদ্যোগ নিতে হবে।”
বাণিজ্য উপদেষ্টা তার বক্তব্যে আরও বলেন, “বর্তমান সময়ে মুদ্রাস্ফীতি আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে মুদ্রাস্ফীতি কমাতে কাজ শুরু করেছে। একই সঙ্গে আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে চেষ্টা চালাচ্ছি। লক্ষ্য একটাই—জনগণের ক্রয়ক্ষমতা ফেরানো।”
তিনি আরও বলেন, “বাজারে কিছুটা বৈচিত্র্য আনতে পেরেছি বলে পণ্যের দামে স্থিতি এসেছে। আগামী দিনে এই প্রচেষ্টা আরও জোরালো হবে। আমরা চাই, পণ্য সহজলভ্য হোক, দাম যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে। এজন্য দরকার একটি কার্যকর নীতি ও তার বাস্তবায়ন।”
সভা শেষে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়, ভোক্তা অধিকার রক্ষায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, সরকার, প্রশাসন এবং ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোকে নিয়ে একটি সমন্বিত ফোরাম গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, “ভোক্তা হচ্ছে দেশের অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু। তার অধিকার নিশ্চিত করতে হলে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এককভাবে কেউ সফল হতে পারে না। সমষ্টিগত প্রচেষ্টাই পারে দেশে একটি ন্যায্য বাজারব্যবস্থা গড়ে তুলতে।”
এই আলোচনার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হলো—বর্তমান সরকার ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় শুধু কাগজে-কলমে নয়, বাস্তবক্ষেত্রে ভোক্তার অধিকার রক্ষায় জোরালো পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত। প্রয়োজন হলে নীতির পরিবর্তন, আইনের সংস্কার, এমনকি প্রশাসনিক পুনর্গঠনের দিকেও যেতে পিছপা হবে না। সবকিছুই একটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে—সাধারণ জনগণ যেন বাজার ব্যবস্থায় ন্যায্য অংশগ্রহণ ও সুযোগ পায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ