
ছবি: সংগৃহীত
শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতিতে ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতার অভাব এবং তা দমন করার জন্য রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের ব্যবহার ছিল ব্যাপক ও প্রাতিষ্ঠানিক। অনলাইনে বা সামাজিক মাধ্যমে কেউ শেখ হাসিনা, সরকার বা কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ করলেই তা 'জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি' হিসেবে বিবেচিত হতো। এই নীতির বাস্তবায়নে ব্যবহৃত হতো একগুচ্ছ কঠোর আইন—তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইন। এসব আইনের আওতায় ভিন্নমত প্রকাশকারী, আন্দোলনে যুক্ত ব্যক্তি, এমনকি সাধারণ নাগরিকদেরও গ্রেফতার, হয়রানি এবং মামলার শিকার হতে হয়েছে।
সম্প্রতি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে গঠিত গুম তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রতিবেদনে এই দমনমূলক নীতির বিস্তৃত বিশ্লেষণ উঠে এসেছে। প্রতিবেদনের কিছু অংশ সোমবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব গণমাধ্যমে প্রকাশ করেন। এতে দেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং আইনগত প্রেক্ষাপটে কীভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হুমকিতে পরিণত হয়েছিল, তার বিস্তারিত চিত্র ফুটে উঠেছে।
একঘেয়ে ফরমায়েশি মামলা, স্ক্রিপ্টেড অভিযোগ
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়েরকৃত বিভিন্ন মামলায় দেখা গেছে, অভিযোগের ভাষা প্রায় একই রকম। বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন—যেমন কোটা সংস্কার, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন—এ অংশগ্রহণ বা ফেসবুকে সরকারি নেতার ছবি পোস্ট করাকেও মামলার মূল অভিযোগ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। অধিকাংশ মামলার এজাহার ও চার্জশিটে একই স্ক্রিপ্ট ব্যবহার করা হয়েছে। এসব মামলার আইনি কাঠামো বিশ্লেষণ করে কমিশন নিশ্চিত হয়েছে যে, মামলাগুলো ছিল পূর্বনির্ধারিত, আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে শুধু ভিন্নমত দমন করাই ছিল উদ্দেশ্য।
‘পালানোর সময়’ গ্রেফতার, ‘গোয়েন্দা তথ্য’ সূত্রে অভিযান
প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রেফতারের সময় পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা প্রায় একই বক্তব্য দিতেন—'সন্দেহভাজন পালানোর সময় ধরা পড়েছে' কিংবা 'বিশেষ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয়েছে'। অথচ এসব অভিযোগ যাচাইয়ের কোনো প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। একই ধরণের 'বেনামি' গোয়েন্দা সূত্র ব্যবহার করে দেশে জবাবদিহিহীন পুলিশি সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা পায়। এসব গ্রেফতার কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই করা হতো এবং আইনি বৈধতা দিতে পালানোর চেষ্টার 'গল্প' তৈরি করা হতো।
অবৈধ স্বীকারোক্তি ও জঙ্গি তকমা
একজন সন্দেহভাজনকে আটক করার পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই 'নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের সদস্য' হিসেবে স্বীকারোক্তি আদায় করার চিত্র উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই স্বীকারোক্তি ছিল পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থার তৈরি, যা আইনের দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে চার্জশিটে ধর্মীয় বই ও সাধারণ পুস্তককে 'জিহাদি' সাহিত্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করে। একটি ব্যাগ বা ড্রয়ারে বিভিন্ন কাগজ রেখে গণমাধ্যমে ‘জিহাদি নথিপত্র’ হিসেবে উপস্থাপন করা হতো।
মামলা পরিচালনায় অসহনীয় আর্থিক চাপ
প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি মামলায় কোনো পরিবারের আইনি খরচ সাত লাখ টাকার মতো হয়েছে, যা তাদের বার্ষিক আয়ের দ্বিগুণ। কেউ কেউ পাঁচ থেকে ছয় বছরের আয় ব্যয় করে মামলা চালিয়েছেন। অনেকেই এই খরচ মেটাতে জমি বা অন্যান্য সম্পদ বিক্রি করেছেন, কেউ কেউ ঋণের চক্রে পড়ে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
মানসিক ক্ষতির বিস্তার
গুম বা অন্যায় গ্রেফতারের কারণে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি মানসিক আঘাতও অপরিসীম ছিল। কমিশনের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৫-১৬ বছর বয়সি কিশোরদের মানসিক ভারসাম্যহীনতা ও ট্রমার চিত্র। এমনকি নির্যাতনের পর তাদের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হয়েছে, যা একটি নির্যাতিত ব্যক্তিকে আরও বেশি মানসিকভাবে ভেঙে দেয়।
আদালতেও প্রভাব বিস্তার
প্রতিবেদনে বলা হয়, ভিন্নমত দমন মামলাগুলো আদালতেও দীর্ঘদিন ঝুলে থাকত, যাতে ভুক্তভোগীদের মানসিক চাপে রাখা যায়। বিচারকরা অনেক সময় রাজনৈতিক চাপের মুখে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারতেন না।
কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, বিচারকদের স্বাধীনভাবে বিচার পরিচালনা করতে উৎসাহিত করতে হবে এবং আপিল বিভাগের নিরপেক্ষ রায়গুলোকে নজির হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এতে আইনের শাসন ও মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
অস্বীকারের সংস্কৃতি
প্রতিবেদনে সবচেয়ে উদ্বেগজনক যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হলো গুমের ঘটনায় অস্বীকারের সংস্কৃতি। আওয়ামী লীগ সরকার কখনোই গুমের অস্তিত্ব স্বীকার করেনি। এমনকি ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পরেও প্রশাসনের মধ্যে এই অস্বীকার প্রবণতা রয়ে গেছে। এতে তদন্ত ব্যাহত হচ্ছে। অনেক প্রমাণ ধ্বংস হয়েছে বা হচ্ছে, সাক্ষীরা হুমকির মুখে রয়েছেন। এমনকি কমিশনের সদস্যরাও মাঠপর্যায়ে গিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর হুমকির মুখে পড়েছেন।
হাজারো মামলা নিষ্পত্তির চ্যালেঞ্জ
বর্তমানে বাংলাদেশে আইনের শাসনের সামনে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো—সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়েরকৃত হাজার হাজার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটভিত্তিক মামলার সুষ্ঠু নিষ্পত্তি। অনেকেই বিনা বিচারে আটক হয়েছেন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কমিশন পরামর্শ দিয়েছে, এসব মামলা নিষ্পত্তিতে পুনর্বাসন ও প্রতিরোধক কৌশল গ্রহণ করতে হবে, সামরিকীকরণ নয়।
এই প্রতিবেদন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে থাকবে, যা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে—কিভাবে একটি সরকার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে ভিন্নমতকে দমন করেছে, মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করেছে এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানিয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ