
ছবি: সংগৃহীত
ইরানে ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের পঞ্চম দিনে এসে ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী চিত্র উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার পর্যবেক্ষণে। ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্টস (HRA) জানিয়েছে, ১৩ জুন থেকে শুরু হওয়া এই সামরিক অভিযানে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন অন্তত ৫৮৫ জন এবং আহত হয়েছেন আরও ১ হাজার ৩২৬ জন। মার্কিন বার্তা সংস্থা এপি (Associated Press) বুধবার এই তথ্য প্রকাশ করেছে, যা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে উদ্বেগ ও ক্ষোভ বাড়ছে।
এই তথ্য এমন এক সময় প্রকাশিত হলো, যখন ইরানের সরকারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সর্বশেষ ১৪ জুন পর্যন্ত দেওয়া তথ্যেই জানিয়েছিল যে, হামলায় নিহত হয়েছেন ২২৪ জন এবং আহত হয়েছেন ১ হাজার ২৭৭ জন। তবে পরবর্তী দিনগুলোতে দেশটির সরকার মৃত বা আহতের সংখ্যা আর আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি। ফলে মানবাধিকার সংস্থার এই নতুন পরিসংখ্যান ইঙ্গিত দিচ্ছে—নীরবতার পেছনে হয়তো একটি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় লুকিয়ে আছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নিহতদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১২৬ জনকে সামরিক এবং ২৩৯ জনকে বেসামরিক নাগরিক হিসেবে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। বাকিদের পরিচয় এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। এপি’র তথ্যমতে, ইসরায়েলের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তেহরান, শিরাজ, ইস্পাহান, কারমানসহ বেশ কয়েকটি বড় শহরের আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা।
স্থানীয় গণমাধ্যমের বরাতে জানা গেছে, বহু ঘরবাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তেহরানের একটি শিশুহাসপাতালের ছাদে বিস্ফোরণের ফলে আগুন ধরে গেলে অন্তত ১১ শিশু মারা যায় বলে দাবি করেছে একটি স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।
ইরানের অভ্যন্তরীণ সংবাদ মাধ্যমগুলোর তথ্যে জানা গেছে, আহতদের অনেকেই গুরুতর অবস্থায় আছেন এবং তাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালগুলোতে তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। হাসপাতাল ও ট্রমা সেন্টারগুলোতে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় অনেককে বারান্দা, করিডোর এমনকি হাসপাতালের বাইরের ফুটপাতেও চিকিৎসা দিতে দেখা গেছে। অক্সিজেন সিলিন্ডার, ওষুধ এবং জরুরি অস্ত্রোপচারের সরঞ্জামও অপ্রতুল হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা।
ইরানের জাতীয় জরুরি পরিষেবা বিভাগের এক কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা এমন একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে আহতরা আসছে, কিন্তু চিকিৎসা দেওয়ার মতো জায়গা, সরঞ্জাম, এমনকি ডাক্তারও যথেষ্ট নেই।”
ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত ১৪ জুন পর্যন্ত একবারই হতাহতের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছিল, রাজধানী তেহরানসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ২২৪ জন নিহত এবং ১ হাজার ২৭৭ জন আহত হয়েছেন। কিন্তু এর পরেও যখন হামলা অব্যাহত ছিল, তখন আর কোনো আপডেট দেওয়া হয়নি।
মানবাধিকার সংস্থা HRA বলছে, সরকার পরিকল্পিতভাবে তথ্য গোপন করছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখ এড়াতে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আছে বলেই দেখানোর চেষ্টা করছে। তাদের মতে, “ইরান সরকার চাইছে না বিশ্ব জানতে পারুক যে, এই হামলা কতটা প্রাণঘাতী ছিল। আমরা স্থানীয় সত্ত্বা, হাসপাতাল ও অ্যাক্টিভিস্টদের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই সংখ্যা নিশ্চিত করেছি।”
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে হামলার দায় স্বীকার করেনি, তবে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সংস্থা এবং মিডিয়ার বরাতে জানা গেছে, ইসরায়েল টার্গেট করেছে মূলত ‘পরমাণু গবেষণা ও সামরিক ইনস্টলেশন’। কিন্তু নিহতদের সংখ্যাগত বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে যে, বেশিরভাগই ছিলেন সাধারণ নাগরিক—যারা হয়তো হামলার মুহূর্তে বাড়ির ভেতরে, রাস্তায় বা কর্মস্থলে ছিলেন।
হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্টস বলেছে, “এই ধরনের হামলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।” সংস্থাটি জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কাছে একটি তদন্তের আবেদনও দাখিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ইরানে এই হামলার ঘটনায় জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “সহিংসতা বন্ধ করুন, সংযত হোন। ইরান-ইসরায়েল সংঘর্ষে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। যুদ্ধ কখনো শান্তি আনতে পারে না।”
তুরস্ক, কাতার, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ফ্রান্সসহ অনেক দেশ ইসরায়েলের এই হামলাকে ‘উসকানিমূলক’ এবং ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সরাসরি কোনো পক্ষ না নিয়ে “সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে শান্তিপূর্ণ সংলাপে বসার” আহ্বান জানিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই হামলা ও হতাহতের পরিসংখ্যান দেখে মনে হচ্ছে—মধ্যপ্রাচ্য আরেকটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। ইসরায়েলের বারবারের হামলা ও ইরানের প্রতিক্রিয়া—দুটোই এখন সামরিক উত্তেজনাকে ভয়াবহ রূপ দিতে পারে। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক কূটনীতির দ্রুত হস্তক্ষেপ ছাড়া মানবিক বিপর্যয় আরও বাড়বে।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্টস এর এই রিপোর্ট শুধু নিহত-আহতের সংখ্যা নয়, বরং যুদ্ধের নৃশংস বাস্তবতা, ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং তথ্য গোপনের গভীর সংকটও সামনে নিয়ে এসেছে—যা গোটা বিশ্বের জন্য এক কঠিন বার্তা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ