
ছবি: সংগৃহীত
ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে চলমান উত্তেজনা এক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে সাম্প্রতিক একতরফা এবং বহুমুখী ইসরায়েলি হামলার মাধ্যমে। এই হামলায় শুধু ইরানের সামরিক ও পরমাণু অবকাঠামো নয়, বরং উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও অর্থনৈতিক স্থাপনাগুলোকেও লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে, যা অঞ্চলজুড়ে আরও অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। অথচ ইসরায়েল এই হামলার যৌক্তিকতা হিসেবে তুলে ধরছে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ‘তাৎক্ষণিক ও অনিবার্য হুমকি’র প্রসঙ্গ। তবে বাস্তবচিত্র বলছে ভিন্ন কথা।
আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (IAEA) ১২ জুনের সর্বশেষ প্রতিবেদনে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি সংক্রান্ত কোনো নতুন বা তাৎক্ষণিক হুমকির উল্লেখ নেই। আর সেখান থেকেই প্রশ্ন উঠছে—ইসরায়েল কি কেবলমাত্র নিরাপত্তা বিবেচনায় এ হামলা চালিয়েছে, নাকি এই হামলার পেছনে রয়েছে গভীর রাজনৈতিক পরিকল্পনা এবং কৌশলগত হিসাব?
ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলায় একাধিক লক্ষ্যবস্তু ছিল, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ইরানের দক্ষিণাঞ্চলের একটি পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র, কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি, গ্যাস ও তেলের গুদাম এবং উচ্চপর্যায়ের সেনা কর্মকর্তাদের বহনকারী গাড়ি বহর। সবচেয়ে আলোচিত লক্ষ্যবস্তু ছিলেন ইরানের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সর্বোচ্চ নেতা খামেনির উপদেষ্টা আলি শামখানি। যদিও ইরান সরকার তার মৃত্যুর খবর আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি, কিন্তু তেহরানের সামরিক সূত্র বলছে, এ হামলায় তিনি গুরুতর আহত হয়েছেন বা নিহত হতে পারেন।
ইসরায়েল দাবি করেছে, এই হামলা প্রতিরোধমূলক এবং তারা বিশ্বাস করে ইরান খুব শিগগিরই পরমাণু অস্ত্র প্রস্তুতের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ বা জোটসঙ্গীদের সমর্থন ছাড়াই কেন ইসরায়েল এ ধরনের আক্রমণ চালাল?
বিশ্লেষকদের মতে, এ হামলা সরাসরি কোনো তাৎক্ষণিক বিপদ রুখতে নয়, বরং কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে তেহরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও নেতৃত্ব কাঠামোকে নড়বড়ে করার চেষ্টা। এটাকে ‘শিরচ্ছেদ কৌশল’ বলা হচ্ছে, যার উদ্দেশ্য শত্রুপক্ষের শীর্ষ নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করে পুরো রাজনৈতিক কাঠামোকে দুর্বল করে ফেলা।
বিশ্লেষক ও মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ ওরি গোল্ডবার্গ আলজাজিরায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে দাবি করেছেন, নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন ইসরায়েল সরকার ইরান হামলার মাধ্যমে কয়েকটি স্পষ্ট লক্ষ্য হাসিল করতে চাচ্ছে। গাজায় সাম্প্রতিক গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যেভাবে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া তীব্র হয়ে উঠেছে—বিশেষ করে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের (ICC) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও ইউরোপীয় কয়েকটি দেশের ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণার পর—সেসব পরিস্থিতি থেকে দৃষ্টি সরাতেই এ ধরনের উত্তেজনা তৈরির চেষ্টায় লিপ্ত নেতানিয়াহু সরকার।
ইসরায়েলি হামলার ধরন ও গভীরতা বিশ্লেষণ করে অনেকেই বলছেন, তেহরানে সরকার পরিবর্তনের ইচ্ছা স্পষ্টভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের টার্গেট করাটা এক ধরনের ‘রাজনৈতিক অপারেশন’, যা একমাত্র ক্ষমতাসীন শাসনব্যবস্থাকে দুর্বল করতে পারে। এটি কেবল যুদ্ধ নয়, বরং ভূ-রাজনৈতিক এক ইঙ্গিত—ইসরায়েল চায়, ইরানে নেতৃত্ব পরিবর্তন হোক এবং একটি নতুন সরকার গঠিত হোক, যেটি হয়তো ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি হবে।
দেশের ভেতরেও কঠিন সময় পার করছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। যুদ্ধকালীন ব্যর্থতা, দুর্নীতি মামলা এবং আন্তর্জাতিক আদালতের নজরদারিতে তিনি নিজেই রাজনৈতিক ঝুঁকিতে রয়েছেন। এমন সময় তিনি নিজেকে আবারও ‘জাতীয় রক্ষাকর্তা’ হিসেবে তুলে ধরতে ইরানের বিরুদ্ধে ‘প্রতীকী জয়’ দেখানোর চেষ্টা করছেন। এই হামলা ইসরায়েলি জনমতকে তার পক্ষে ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হয়েছে বলেই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলছেন, এই ধরণের আগ্রাসী পদক্ষেপে তেহরান যেমন জবাব দিতে বাধ্য হবে, তেমনই গোটা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধের বিস্তার এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ভেঙে পড়ার আশঙ্কাও বাড়বে। ইরান ইতিমধ্যে পাল্টা হামলা শুরু করেছে এবং আঞ্চলিক জোটগুলোকেও প্রস্তুত থাকতে বলেছে।
ইসরাইলের এই আক্রমণ কি সত্যিই ‘নিরাপত্তা রক্ষার’ জন্য ছিল, নাকি একটি সূক্ষ্ম রাজনৈতিক নাটক? যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নেতানিয়াহুর সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুলছে, তখন ইরানকে ‘অত্যাচারী শক্তি’ হিসেবে চিত্রিত করা এবং প্রতিরোধের নামে বোমা বর্ষণের মাধ্যমে ইসরাইল কি আসলেই নিরাপদ হচ্ছে? নাকি এ কৌশল আরও গভীর সঙ্কটের জন্ম দিচ্ছে?
যে কারণেই হোক, এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক উত্তাপকে এক নতুন ও বিপজ্জনক মাত্রায় নিয়ে গেছে। পরবর্তী পরিস্থিতি নির্ভর করবে, তেহরান এই আক্রমণকে কিভাবে দেখছে—শুধু প্রতিরোধ হিসেবে, নাকি যুদ্ধের ঘোষণাস্বরূপ। আর বিশ্ব কি কেবল দর্শক হয়েই থাকবে, নাকি এই উত্তেজনা প্রশমনে কার্যকর উদ্যোগ নেবে?
বাংলাবার্তা/এমএইচ