
ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীর শাহবাগ ও পল্টন থানায় দায়ের করা দুটি পৃথক মামলায় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এবং বাংলাদেশ পিপলস পার্টির (বিপিপি) চেয়ারম্যান বাবুল সরদার চাখারীকে রিমান্ডে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এম. মিজবাহ উর রহমান। বুধবার (১৮ জুন) শুনানি শেষে আদালত এই আদেশ দেন।
আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে পাঁচ দিনের এবং অপর দুই নেতা মোশাররফ হোসেন ও বাবুল সরদার চাখারীকে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। দুই মামলাই রাজনৈতিক অস্থিরতা, সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
বুধবার সকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আনিসুল হক, মোশাররফ হোসেন ও বাবুল সরদারকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে আদালতে হাজির করে। এরপর শাহবাগ থানায় দায়ের হওয়া একটি হত্যা মামলায় আনিসুল হকের ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়। একইভাবে পল্টন থানায় দায়ের হওয়া হত্যাচেষ্টা মামলায় মোশাররফ হোসেন ও বাবুল সরদারের ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, পল্টন থানার উপপরিদর্শক বিমান তরফদার।
দুইটি মামলার শুনানি শেষে আদালত আনিসুল হকের পাঁচ দিনের এবং অপর দুই নেতার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
শাহবাগ থানার মামলার অভিযোগপত্র অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৫ আগস্ট রাজধানীর চাঁনখারপুল এলাকায় ‘জুলাই গণআন্দোলন’-এ ছাত্র-জনতার সঙ্গে রাজপথে ছিলেন ক্ষুদ্র জুট ব্যবসায়ী মো. মনির। তিনি ওইদিন আন্দোলনে সরাসরি অংশ নেন। অভিযোগে বলা হয়, দুপুরের দিকে হঠাৎ পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ সময় আসামিরা হঠাৎ গুলি ছোড়ে। মনির ঘটনাস্থলেই মারা যান।
নিহতের স্ত্রী শোকে স্তব্ধ হয়ে কিছুদিন সময় নেন। পরে, ২০২৪ সালের ১৪ মার্চ শাহবাগ থানায় আনুষ্ঠানিকভাবে হত্যা মামলা করেন তিনি। মামলায় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকসহ বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকে অভিযুক্ত করা হয়। মামলার তদন্তে উঠে আসে, ওই দিনকার ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে এমন একাধিক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীর, যারা সরাসরি গুলি ছুড়েছিলেন বা উস্কানি দিয়েছিলেন বলে দাবি করেছে তদন্ত সংস্থা।
অপরদিকে, পল্টন থানার মামলার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের কর্মী বদরুল ইসলাম সায়মন। মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর রাজধানীর পল্টনে আয়োজিত এক মহাসমাবেশে অংশ নেন তিনি। এই সমাবেশে অংশ নেয় বিএনপি, গণঅধিকার পরিষদসহ সমমনা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। সমাবেশের মূল উদ্দেশ্য ছিল: “স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতন, গুম-খুন-নিপীড়নের প্রতিবাদ এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি।”
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে অভিযোগে বলা হয়, সেদিনের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হঠাৎ করে পুলিশি উপস্থিতির পাশাপাশি সশস্ত্র কিছু ব্যক্তি সমাবেশ লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এই গুলিতে বদরুল ইসলাম সায়মন গুলিবিদ্ধ হন। আহত অবস্থায় তাকে দ্রুত উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে সুস্থ হয়ে ২০২৪ সালের ২৯ এপ্রিল তিনি পল্টন থানায় মামলা দায়ের করেন।
সায়মনের করা মামলায় প্রধান আসামি করা হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। এ ছাড়া আরও ২৪৪ জন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হয়। মামলার অন্যতম অভিযুক্ত হিসেবে ছিলেন মোশাররফ হোসেন ও বাবুল সরদার চাখারী। এ মামলাতেও উল্লেখ করা হয়, হামলাকারীরা সেদিন গুলি চালিয়ে শুধু সাধারণ কর্মীদের নয়, সাংবাদিক ও পথচারীদেরও আতঙ্কিত করে তোলে।
দুটি মামলাই রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র আলোড়ন তুলেছে। একদিকে সরকারের সাবেক দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে সরাসরি সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ, অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক মামলার অভিযোগ তুলে সরকারের পক্ষ থেকে পাল্টা বক্তব্য আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে, রিমান্ড শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ জানিয়েছে, “আসামিরা একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক সহিংসতার সঙ্গে যুক্ত। এই সহিংসতার লক্ষ্য ছিল সরকারকে বিব্রত ও আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে দেওয়া।” তবে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা দাবি করেন, এই মামলাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তারা আদালতের কাছে রিমান্ড বাতিলের আবেদন করেন, তবে বিচারক রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রিমান্ডে নেওয়ার মাধ্যমে পুলিশ হয়তো আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বা সংশ্লিষ্টতা উদঘাটন করতে পারবে। তবে এই রিমান্ড যেন মানবাধিকার লঙ্ঘন না করে—সেই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার সংগঠনগুলো। তারা নজর রাখছে এই মামলার তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়ার ওপর।
দেশের রাজনীতিতে নতুন করে উত্তাপ ছড়িয়েছে সাবেক দুই মন্ত্রী এবং এক রাজনৈতিক দলের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা ও রিমান্ড আদেশ। মামলার পটভূমি, রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আসামিদের পরিচিতি—সবকিছু মিলিয়ে এটি নিঃসন্দেহে একটি উচ্চপ্রোফাইল মামলায় রূপ নিয়েছে। এখন দেখার বিষয়, রিমান্ডে তদন্তকারীরা কী তথ্য বের করতে পারেন এবং এর পরবর্তী বিচারিক প্রক্রিয়া কোন পথে গড়ায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ