
ছবি: সংগৃহীত
নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ এবং বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই প্রণীত হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন। কিন্তু সেই আইনের ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার সুস্পষ্ট বিধান থাকলেও বাস্তবচিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। দেশের ট্রাইব্যুনালগুলোতে নারী ও শিশু নির্যাতনের ৩৫ হাজার ২৬২টি মামলা পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঝুলে আছে। ফলে ন্যায়বিচার প্রত্যাশীরা বছরের পর বছর ঘুরেও কোনো ফল পাচ্ছেন না। আদালত, আইনজীবী, পুলিশ, ভুক্তভোগী পরিবার—সবারই হতাশা বাড়ছে দিনকে দিন।
ঢাকার একটি মামলার চিত্র: ৯ বছরেও হয়নি বিচার
ঢাকার খিলক্ষেত এলাকার একটি ঘটনার মাধ্যমে যদি পুরো পরিস্থিতির প্রতিফলন বোঝা যায়, তাহলে তা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। নয় বছর আগে মাত্র নয় বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়। এ মামলায় এখন পর্যন্ত ৯৬টি শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। অভিযোগ গঠনের পরও বিচার কার্যক্রম শেষ হয়নি। মামলার সাক্ষীদের মধ্যে ছয় জন এখনো আদালতে হাজির হননি। ফলে বিচার অকারণে দীর্ঘসূত্রতায় পড়েছে।
চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত এক শুনানিতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ এর বিচারক স্পষ্ট ভাষায় বলেন, সাক্ষীদের অনুপস্থিতির কারণেই মামলাটি নিষ্পত্তিতে বারবার বিলম্ব হচ্ছে। আদালত চারজন সাক্ষীর বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে তাদের খিলক্ষেত, গাইবান্ধা, নীলফামারী ও মাদারীপুর থানার মাধ্যমে আদালতে হাজির করতে নির্দেশ দেন। তবে ২১ মে নির্ধারিত দিনে কেউ হাজির হননি।
আদালতের একজন কর্মচারী জানিয়েছেন, সাক্ষীরা অনুপস্থিত থাকায় শুনানি পিছিয়ে দিতে হয়। অথচ সংশ্লিষ্ট থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) বলছেন, তারা আদালতের কোনো আদেশ পাননি। আদালত আর পুলিশের এই সমন্বয়হীনতা বিচারে বড় বাধা হিসেবে দাঁড়াচ্ছে।
বিচারপ্রক্রিয়ার ধীরগতির চিত্র সারাদেশেই
সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০২৪ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১ লাখ ৪৮ হাজার ৩১৪টি। এর মধ্যে গত এক বছরে নতুন করে ৩৩ হাজার ৪৮৫টি মামলা দায়ের হয়েছে। তবে এর বিপরীতে নিষ্পত্তি হচ্ছে খুবই অল্পসংখ্যক মামলা। বিশেষভাবে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে ঝুলে থাকা মামলার সংখ্যা ৩৫ হাজার ২৬২টি।
হাইকোর্টের নির্দেশনা, বাস্তবায়ন হয়নি
২০১৬ সালে হাইকোর্ট একটি যুগান্তকারী নির্দেশনা দেয়। সে অনুযায়ী, নারী ও শিশু নির্যাতন মামলাগুলোর অগ্রগতি পর্যবেক্ষণের জন্য সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের নেতৃত্বে একটি বিশেষ সেল গঠনের কথা বলা হয়। সেই সেলের দায়িত্ব ছিল, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে কি না, তা নজরদারি করা এবং প্রয়োজনীয় রিপোর্ট প্রদান করা।
তবে সুপ্রিম কোর্ট সূত্র জানিয়েছে, এই সেল এখন কার্যত অচল। আদালতের মুখপাত্র মুয়াজ্জেম হোসেনও জানিয়েছেন, তিনি সেলের বর্তমান কার্যক্রম সম্পর্কে জানেন না। যদিও তিনি এটাও জানান যে, দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে বিচারপতিদের নেতৃত্বে ১৩টি কমিটি গঠন করা হয়েছে, যেগুলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলাও দেখভাল করছে।
আইন মন্ত্রণালয়ের আশ্বাস, বাস্তবে অগ্রগতি কম
একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, বর্তমানে দেশে ১০১টি ট্রাইব্যুনাল রয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলার জন্য। আরও কিছু ট্রাইব্যুনাল গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। কিন্তু বিচারিক কাঠামোর চাপ, প্রসিকিউশনের সীমাবদ্ধতা এবং পুলিশের দুর্বল প্রস্তুতি এসব পরিকল্পনার কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।
কী বলছেন আইন বিশেষজ্ঞরা?
সিনিয়র আইনজীবী খুরশীদ আলম খান মনে করেন, যেহেতু আইনে নির্ধারিত ১৮০ দিনের সময়সীমা বাধ্যতামূলক নয়, তাই রাষ্ট্রপক্ষ ও বিচার ব্যবস্থার আন্তরিকতা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তার মতে, সুপ্রিম কোর্টের অধীনে একটি কার্যকর সচিবালয় গঠন করা উচিত, যারা বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ করবে এবং প্রয়োজনে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির মধ্যে আনবে।
আইনজীবী শুক্লা সারওয়াত সিরাজ বলেন, "আইন ভালো থাকলেও প্রয়োগ দুর্বল। অনেক ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন না, কেউ করলে তদন্তে নানা সমস্যা, আবার সাক্ষীরা ভয় পেয়ে মুখ খোলেন না। পুলিশ অনেক সময় প্রভাবশালীদের চাপে পড়ে আসামিপক্ষকে সহযোগিতা করে।"
তিনি বলেন, "ডিএনএভিত্তিক প্রমাণ, ফরেনসিক রিপোর্ট—সবই অপ্রতুল বা বিলম্বিত। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটররা অনেক সময় আগ্রহী নন, সাক্ষীরা বারবার না আসায় বিচার পিছিয়ে যায়।" তিনি আরও বলেন, “নারী ও শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে আইন দিয়ে কিছু হয় না।”
আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, “এই আইনটি ছিল একটি আশ্বাস—অত্যাচারের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার ও সুরক্ষার। অথচ আজকের বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, ১৮০ দিনের বদলে পাঁচ বছর বা তার বেশি সময়েও রায় হয় না।”
তার মতে, পুলিশের তদন্তে গাফিলতি, ফরেনসিক রিপোর্ট পেতে বছরের পর বছর, বিচারকের শুনানি মুলতবি করার প্রবণতা, সাক্ষীদের অনুপস্থিতি সব মিলিয়ে একটা ভঙ্গুর কাঠামো তৈরি হয়েছে। যার শিকার হচ্ছেন ভুক্তভোগী নারী ও শিশু।
তিনি বলেন, “শুধু মামলা দিয়ে বিচার পাওয়া যায় না, এর পেছনে দরকার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, প্রশিক্ষিত ও নিষ্ঠাবান প্রসিকিউশন টিম, নিরাপত্তা, সামাজিক সচেতনতা ও মানবিক সহায়তা।”
দণ্ডের হার আশঙ্কাজনকভাবে কম
বিশ্লেষণ বলছে, দীর্ঘসূত্রতা, সাক্ষীর অনুপস্থিতি ও প্রমাণের দুর্বলতায় এসব মামলায় দণ্ডাদেশের হার আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। অনেক জেলাতে এই হার ৩ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। অর্থাৎ শতকরা ৯৭ ভাগ মামলাতেই অভিযুক্তরা আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়। ফলে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুরা বিচার থেকে বঞ্চিত হন এবং অপরাধীরা আরও সাহস পায়।
কোথায় সমাধান?
বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ অনুযায়ী, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এখনই গ্রহণ করা জরুরি—
অধিক ট্রাইব্যুনাল গঠন ও বিদ্যমান ট্রাইব্যুনালের জনবল ও সরঞ্জাম বাড়ানো
সাক্ষীদের নিরাপত্তা ও আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করা
পুলিশ ও প্রসিকিউশনের দক্ষতা ও দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি
সাক্ষ্য ও ডিএনএ প্রমাণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের উন্নত পদ্ধতি
“বিচার মুলতবি না করার নীতি” কঠোরভাবে বাস্তবায়ন
সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যম ও শিক্ষাক্ষেত্রে কার্যক্রম
একজন ট্রাইব্যুনাল বিচারকের ভাষায়, “এই মামলাগুলো শুধু আইনি লড়াই নয়, এটি ভুক্তভোগীর জীবনের লড়াই। আমরা যদি দ্রুত বিচার দিতে না পারি, তাহলে আইন শুধু কাগজেই থেকে যাবে।”
নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে একটি কার্যকর আইন থাকলেও, তার বাস্তব প্রয়োগ এবং বিচারপ্রক্রিয়ার গতিশীলতা না থাকলে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে না। এখন প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক দক্ষতা—যাতে এসব বিচার দীর্ঘসূত্রতার গহ্বরে হারিয়ে না যায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ