
ছবি: সংগৃহীত
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) ফের একযোগে পুশইনের পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে রোহিঙ্গা ও ভারতীয় নাগরিকসহ অন্তত ৫৭ জনকে। গত শুক্রবার রাত থেকে শুরু করে শনিবার (১৫ জুন) সকাল পর্যন্ত সীমান্তবর্তী চারটি জেলার অন্তত পাঁচটি পয়েন্ট দিয়ে এসব মানুষকে বাংলাদেশে প্রবেশ করিয়ে দেয় বিএসএফ। পুশইনের ঘটনার পর বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) তৎপর হয়ে তাদের আটক করে। পরে স্থানীয় থানা-পুলিশের সহায়তায় প্রয়োজনীয় আইনি প্রক্রিয়া শুরু করা হয়।
এই পুশইন ঘটেছে ঠাকুরগাঁও, মৌলভীবাজার, পঞ্চগড় ও চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে। বিজিবির চারটি ব্যাটালিয়ন অভিযানে অংশ নেয় এবং সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে আটককৃতদের হস্তান্তর করে।
ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলার চাপসার সীমান্ত দিয়ে রাতের আঁধারে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় ২৩ জনকে। এর মধ্যে রয়েছেন ৫ জন পুরুষ, ১২ জন নারী ও ৬ জন শিশু।
এ বিষয়ে হরিপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাকারিয়া মণ্ডল বলেন, “বিজিবি আমাদের কাছে ২৩ জনকে হস্তান্তর করেছে। তাদের পরিচয় যাচাইয়ের কাজ চলছে।”
দিনাজপুর ৪২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মঈন হাসান বলেন, “আমরা প্রত্যেকের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য যাচাই-বাছাই করছি। তারা বাংলাদেশের নাগরিক হলে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা এবং যদি না হয়, তাহলে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
ঠাকুরগাঁও ৫০ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানজির আহম্মদ বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্ত দিয়ে পুশইনের প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। আমরা স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে আছি।”
মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার কুমারশাইল সীমান্ত দিয়ে ১২ জন রোহিঙ্গা মুসলমানকে বাংলাদেশে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়।
বিজিবি-৫২ ব্যাটালিয়নের টহল দল তাদের আটক করে। পরে যাচাই-বাছাই করে জানা যায়, তারা কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী শরণার্থী ক্যাম্পের বাসিন্দা।
বিজিবি ৫২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ বলেন, “তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর আমরা তাদের থানায় সোপর্দ করেছি। এখন সংশ্লিষ্ট শরণার্থী ক্যাম্পে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”
বড়লেখা থানার ওসি আবুল কাশেম সরকার বলেন, “আটককৃতদের আইনানুগভাবে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। শরণার্থী সংস্থাগুলোর সহায়তায় ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হবে।”
পঞ্চগড় জেলার সদর উপজেলার মিরগড় ও তেঁতুলিয়া উপজেলার পেদিয়াগজ সীমান্ত দিয়ে ১৬ জনকে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৪ জন ভারতীয় নাগরিক এবং ১২ জন বাংলাদেশি রয়েছেন।
বাংলাদেশিদের মধ্যে ৬ জন নারী, ২ শিশু ও ৪ জন পুরুষ। বিজিবি ১৮ ব্যাটালিয়ন সূত্র জানায়, আটক ব্যক্তিদের মধ্যে ভারতীয়দের পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং বাংলাদেশিদের পরিচয় যাচাই শেষে স্থানীয় থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার ঠাকুরপুর সীমান্ত দিয়ে একই পরিবারের ৬ জনকে বিএসএফ পুশইন করে। এরা সবাই কুড়িগ্রাম জেলার বাসিন্দা বলে জানা গেছে।
দর্শনা থানার ওসি মুহাম্মদ শহীদ তিতুমীর জানান, “বিজিবি আমাদের কাছে ৬ জনকে হস্তান্তর করেছে। তারা একই পরিবারের সদস্য। আমরা তাদের স্বজনদের খবর দিয়েছি এবং প্রয়োজনীয় আইনি প্রক্রিয়া শুরু করেছি।”
বিজিবির বিভিন্ন ব্যাটালিয়নের কমান্ডাররা জানিয়েছেন, পুশইন একটি আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন, যা দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এভাবে নিয়মিত পুশইন হলে সীমান্তে অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে।
এ বিষয়ে বিজিবির পক্ষ থেকে ভারতের সংশ্লিষ্ট বাহিনীর সঙ্গে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে আপত্তি জানানো হয়েছে। প্রয়োজন হলে উচ্চপর্যায়ে কূটনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান করা হবে বলে জানান বিজিবির কর্মকর্তারা।
সীমান্ত বিশ্লেষকদের মতে, ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ বা পুশইনের ঘটনা বরাবরই সংবেদনশীল বিষয়। সম্প্রতি ভারতে অবৈধ অভিবাসী বিরোধী অভিযান বেড়ে যাওয়ায় রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ধরপাকড় এবং তারপর পুশইনের ঘটনা বাড়ছে।
এ ছাড়া সীমান্তে নজরদারির ঘাটতি, যৌথ ব্যবস্থাপনার অভাব এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবও এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে ভূমিকা রাখছে।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের এই ধরনের একতরফা পুশইন কৌশল কেবল দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কেই ফাটল ধরায় না, বরং সীমান্তে নিরাপত্তা হুমকি তৈরি করে। বিজিবি ও স্থানীয় প্রশাসন তাৎক্ষণিকভাবে পদক্ষেপ নিলেও, এর স্থায়ী সমাধানে জোরালো কূটনৈতিক পদক্ষেপ ও আন্তর্জাতিক চাপে ভারতের এমন আচরণের জবাব চাওয়ার সময় এসেছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ