
ছবি: সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার পারদ যখন ক্রমাগত চড়ছে, ঠিক তখনই ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা ইসরাইলের অভ্যন্তরে দ্বিতীয়বারের মতো বড় ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। ইরানের পক্ষ থেকে চালানো পাল্টা সামরিক আঘাতের মধ্যেই হুতিদের এই হামলা নতুন করে আন্তর্জাতিক উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। ইরানের সঙ্গে কৌশলগত সমন্বয় করে হুতিদের এই হামলা শুধু ইসরাইলের সামরিক চাপ নয়, বরং কূটনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে জোট-প্রতিজোটের সম্ভাবনাও উন্মোচন করছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
শনিবার (১৪ জুন) রাতভর ইরানজুড়ে চলা ইসরায়েলি বিমান হামলার জবাবে মধ্যরাতের ঠিক পরপরই ইরান তেল আবিবসহ ইসরাইলের নানা লক্ষ্যবস্তুতে শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। একইসঙ্গে হুতি বিদ্রোহীরাও ইয়েমেন থেকে ইসরাইলের বিভিন্ন অংশে ব্যালিস্টিক ও হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। এটি ছিল গত এক সপ্তাহের মধ্যে হুতিদের দ্বিতীয় আক্রমণ। তারা আল মাসিরাহ টেলিভিশনের মাধ্যমে এক বিবৃতিতে জানায়, ইরানি বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি সমন্বয় করেই তারা এই হামলা চালিয়েছে।
হুতি বাহিনীর দাবি অনুযায়ী, তারা ‘ফিলিস্তিন-২’ হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রসহ বিভিন্ন ধরনের উন্নত প্রযুক্তির অস্ত্র ব্যবহার করেছে। এসব ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের কেন্দ্রস্থল লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করা হয়, যার ফলে আশপাশের অনেক অঞ্চলজুড়ে সাইরেন বেজে ওঠে এবং মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে ছোটে।
ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) নিশ্চিত করেছে, ইয়েমেন থেকে ইসরাইলের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে এবং এসব হামলার পেছনে হুতিরাই রয়েছে। ইসরাইলি সামরিক মুখপাত্র জানান, “ইরান ও তার মিত্রগোষ্ঠী একত্রে আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। হুতিদের এই আক্রমণ একটি সমন্বিত আঞ্চলিক হামলার অংশ।”
এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইসরাইলও পূর্বের মতো হুতিদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ইয়েমেনের হোদেইদা বন্দরে বিমান হামলা চালায়, তবে হুতিরা আগেই জানিয়েছিল—যতক্ষণ ইসরাইল গাজায় আগ্রাসন চালাবে, ততক্ষণ তারা হামলা বন্ধ করবে না।
আল জাজিরার তথ্য অনুযায়ী, ইরান ও হুতিদের হামলার ফলে ইসরাইলের বিভিন্ন শহরে বিশাল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বাত ইয়াম এলাকায় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয়েছে, যেখানে ৭৪ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৩ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। রেহোবত শহরে ২৮ জন আহত হয়েছে। এছাড়া, বেশ কয়েকটি শহরে বহুতল ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ৩৫ জনের বেশি মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ইসরাইলি গণমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, সর্বশেষ ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তেল আবিবেই অন্তত সাতজন ইসরায়েলি সেটেলার নিহত হয়েছেন এবং শতাধিক আহত। ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের লক্ষ্যবস্তু ছিল তেল গবেষণা ও অস্ত্র উন্নয়ন খাতের জন্য বিখ্যাত ওয়েইজম্যান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স। এ প্রতিষ্ঠানটির একটি গবেষণাগারে বিস্ফোরণের ফলে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে এবং ভেতরে অনেকে আটকা পড়েছেন।
এদিকে ইরানি গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, ইসরাইলের বিমান হামলায় তাদের বেশ কয়েকজন শীর্ষপর্যায়ের সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া এই বোমাবর্ষণে ইতোমধ্যেই ৮০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ২০ জন শিশু রয়েছে। আহত হয়েছেন প্রায় ৮০০ জন।
ইসরাইলবিরোধী মনোভাবকে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে হুতিদের শীর্ষ নেতা আবদুল মালিক আল-হুতি বলেন, “শুধু ইরান নয়, পুরো অঞ্চলের দেশগুলোর দায়িত্ব হলো ইসরাইলকে প্রতিহত করা। গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইল যে নৃশংসতা চালাচ্ছে, তা পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এই আগ্রাসন রোধ করতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “শত্রুকে প্রতিহত করা, তার দমন-পীড়নের অবসান ঘটানো এখন শুধু মানবিক দায়িত্ব নয়, বরং এটি কৌশলগত প্রয়োজনও। আমাদের এই প্রতিরোধ চলবে যতক্ষণ না গাজায় ন্যায়বিচার ফিরে আসে।”
বিশ্লেষকদের মতে, হুতি বিদ্রোহীদের এই হামলা কেবল ইসরাইল-ইরান দ্বন্দ্ব নয়, বরং এক বিস্তৃত আঞ্চলিক সংঘাতের পূর্বাভাস দিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমানে ইসরাইল, ইরান, লেবাননের হিজবুল্লাহ, সিরিয়া এবং ইয়েমেনের হুতি—সব পক্ষই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে, যা পুরো অঞ্চলকে ভয়াবহ যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও তেহরানের মধ্যে চলমান পরমাণু আলোচনা যখন সবচেয়ে স্পর্শকাতর অবস্থায় রয়েছে, তখন ইসরাইলের একতরফা হামলা এবং এর পাল্টা প্রতিক্রিয়া একটি বড় যুদ্ধের দিকে পরিস্থিতিকে নিয়ে যেতে পারে।
ইসরাইল-ইরান দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে হুতিদের এই সমন্বিত হামলা মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। গাজায় চলমান যুদ্ধ, ইসরাইলের আগ্রাসন, ইরানের প্রতিরোধ এবং হুতিদের প্রতিক্রিয়া সব মিলিয়ে এখন এক জটিল কূটনৈতিক ও সামরিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। যার সমাধান অনিশ্চিত, আর ফলাফল হতে পারে বহুদূরপ্রসারী।
বাংলাবার্তা/এমএইচ