
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা পরিবর্তনের পরিকল্পনা চলছে—এমন একটি গুজব সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও কিছু বিদেশি ওয়েবসাইটে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এই দাবিকে ‘সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে নাকচ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। তারা জানিয়েছে, এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত সরকার গ্রহণ করেনি, এমনকি কোনো আলোচনাও হয়নি।
এ বিষয়ে সিএ প্রেস উইং ফ্যাক্ট, প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক বিবৃতিতে স্পষ্টভাবে জানানো হয়, “জাতীয় পতাকা পরিবর্তনের কোনো চিন্তাভাবনা অন্তর্বর্তী সরকার করছে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো এসব খবর সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর এবং জনমনে অস্থিরতা তৈরির উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে প্রচারিত।”
এই গুজবের সূত্রপাত হয় ২০২৫ সালের ৪ জুন, @SouthAsiaIndex নামের একটি পাকিস্তানপন্থী এক্স (পূর্বের টুইটার) অ্যাকাউন্ট থেকে, যেখানে প্রথম একটি ডিজিটালভাবে তৈরি কল্পিত পতাকার ছবি শেয়ার করা হয়। সেই ছবিতে বাংলাদেশের সবুজ-লাল পতাকার পরিবর্তে ইসলামী প্রতীক হিসেবে চাঁদ ও তারা যোগ করা হয়, যা পাকিস্তান ও তুরস্কের জাতীয় পতাকার সঙ্গে মিল রয়েছে।
এরপর ওই কল্পিত পতাকার ছবি এবং সংশ্লিষ্ট ভুয়া তথ্য আন্তর্জাতিক এক্স ব্যবহারকারীদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষত, একটি ভুয়া প্রতিবেদনের মাধ্যমে বিষয়টি আরও চাঞ্চল্যকর করে তোলে। ওই ভুয়া রিপোর্টটির শিরোনাম ছিল: “বাংলাদেশ তার পতাকায় পাকিস্তান ও তুরস্কের অনুকরণে ইসলামি চাঁদ যোগ করার কথা ভাবছে”, যা একজন ‘রবার্ট ব্রাউন’ নামধারী কথিত লেখকের নামে প্রকাশিত হয় ৬ জুন, এবং সেটি যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি, তাও পরবর্তীতে নিশ্চিত হয়।
প্রেস উইং বিশেষভাবে উল্লেখ করে যে, এই ভুয়া প্রতিবেদনটি ছড়াতে সাহায্য করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, যিনি তার এক্স প্রোফাইলে ওই ভুয়া খবর শেয়ার করেন। তার এই পোস্টের মাধ্যমে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয় এবং একটি ভুল বার্তা ছড়িয়ে পড়ে যে—বাংলাদেশ ইসলামী ধাঁচে পতাকা পরিবর্তনের দিকে এগোচ্ছে।
প্রেস উইং বলছে, “সজীব ওয়াজেদসহ বহু ব্যবহারকারী এই মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদন প্রচারে ভূমিকা রেখেছেন। এতে মধ্যপ্রাচ্য, পাকিস্তান ও তুরস্কের ব্যবহারকারীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস এবং বাংলাদেশিদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়।”
বাংলাদেশি ফ্যাক্টচেকিং প্ল্যাটফর্ম ‘দ্য ডিসেন্ট’ জানিয়েছে, এই রিপোর্টের কোনো তথ্যসূত্র বা প্রমাণ নেই। এটি একেবারেই কল্পিত এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় লেখা হয়েছে। তারা এটিও নিশ্চিত করেছে যে, বাংলাদেশে জাতীয় পতাকা পরিবর্তনের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে জাতীয় পর্যায়ে কোনো প্রস্তাব, আলোচনা, বা গণদাবি নেই।
ফ্যাক্টচেক সংগঠনটি আরো জানায়, এই গুজবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ইসলামপন্থী ও রক্ষণশীল শ্রোতাদের মধ্যে ধর্মীয় পরিচয়-ভিত্তিক উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে। সামাজিক বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই এমন প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে।
প্রেস উইংয়ের ভাষ্যমতে, “এই মিথ্যাচার ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহার করে বাংলাদেশে পরিচয়-ভিত্তিক রাজনীতি উসকে দেওয়ার পরিকল্পিত প্রয়াস।”
প্রেস উইং আরও জানায়, ১৪ জুন ২০২৫ পর্যন্ত বাংলাদেশের মূলধারার কোনো জাতীয় পত্রিকা, টেলিভিশন চ্যানেল বা আন্তর্জাতিক স্বীকৃত গণমাধ্যম এই জাতীয় পতাকা পরিবর্তনের সম্ভাবনা বা সরকারি আলোচনার বিষয় নিয়ে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। এতে পরিষ্কার হয়ে যায়, গুজবের ভিত্তি একেবারেই দুর্বল এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
প্রেস উইং আরও মনে করিয়ে দেয়, এটাই প্রথম নয়। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে গণ-আন্দোলনের সময়ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একই ধরনের গুজব ছড়ানো হয় যে ছাত্রনেতারা নতুন জাতীয় পতাকার প্রস্তাব দিয়েছেন। সেই সময় @AsianDigest নামের একটি অ্যাকাউন্টে এমন পোস্ট ছড়ায়, যা ৯০ হাজারের বেশি ভিউ পায়। পরবর্তীতে সে দাবিও ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়।
প্রেস উইং এক বিবৃতিতে দেশের নাগরিক এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, “গুজব না ছড়ানো এবং ভুয়া তথ্য না শেয়ার করার দায়িত্ব আমাদের সবার। এমন সংবেদনশীল বিষয়ে মতপ্রকাশের আগে সত্যতা যাচাই করা উচিত।”
তারা আরও যোগ করে, “জাতীয় পতাকা বাংলাদেশের আত্মপরিচয়, ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক। এ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো অত্যন্ত দুঃখজনক। চলুন আমরা সত্য তথ্যকে প্রাধান্য দিই এবং ভিত্তিহীন গুজব ছড়ানো থেকে বিরত থাকি।”
সামাজিক মাধ্যমে জাতীয় পতাকা পরিবর্তন নিয়ে ছড়ানো গুজব একটি পরিকল্পিত বিভ্রান্তি, যা কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্য এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদার ওপর সরাসরি আঘাত হানার চেষ্টা চালানো হয়েছে। প্রেস উইং, ফ্যাক্টচেক সংগঠন ও গণমাধ্যমসমূহ একযোগে এই গুজব খণ্ডন করে প্রমাণ করেছে, দেশের পতাকা পরিবর্তনের কোনো সিদ্ধান্ত বা চিন্তাভাবনা আদৌ সরকারের নেই। এখন সময় সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর, এবং ডিজিটাল বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়ানোর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ