
ছবি: সংগৃহীত
তীব্র উত্তেজনার মধ্যেই ইসরাইলের রাজধানী তেল আবিব এবং ঐতিহাসিক শহর জেরুজালেমে ইরানের ভয়াবহ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু হয়েছে। রোববার দিবাগত রাতের প্রথম দফা হামলার কয়েক ঘণ্টা পর নতুন করে আরেক দফা ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে তেহরান। এতে দুটি শহরের বিভিন্ন জায়গায় আগুন ধরে গেছে, বিস্ফোরণের শব্দে প্রকম্পিত হয়েছে আকাশ-বাতাস। এ ঘটনায় হতাহত হয়েছেন বহু মানুষ। ভয়াবহ হামলার কারণে শহরের রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে গেছে, মানুষ ছুটছে বাঙ্কার ও আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে পুরো দেশজুড়ে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, রোববার রাতেই ইরান আবারো বড় ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করে। এই দফার আক্রমণ ছিল অধিক তীব্র ও বিস্তৃত। তেল আবিব ও জেরুজালেমে বেশ কয়েকটি জায়গায় আগুন ধরে যায়, বিশেষ করে বেসামরিক এলাকার বিভিন্ন ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একের পর এক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে শহরজুড়ে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, তাদের ঘরের জানালাও কেঁপে উঠেছে ভয়াবহ শব্দে।
ইসরাইলি সাংবাদিক হ্যাগি মাতার এক্স (সাবেক টুইটার)-এ এক পোস্টে জানিয়েছেন, “তেল আবিবে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ চলছে। কিছু এলাকায় বড় ধরণের বিস্ফোরণ হয়েছে। আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।” তাঁর মতে, ২০১৪ সালের গাজা যুদ্ধের পর এটি সবচেয়ে ভয়ানক রাত।
ইসরাইলের জাতীয় জরুরি সেবা সংস্থা এমডিএ (Magen David Adom) জানিয়েছে, ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে এখন পর্যন্ত ২০ জন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। হাইফা শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় পাঁচজন আহত হন এবং গ্যালিলি অঞ্চলের একটি দোতলা ভবনে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাতে অন্তত ১৪ জন আহত হয়েছেন বলে সংস্থাটি নিশ্চিত করেছে।
এছাড়া ম্যাডিসিস নামের এক মেডিকেল সংগঠন এবং ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি দাবি করছে, ইসরাইলের উত্তরের এক অঞ্চলে ইরানের ছোড়া মিসাইলে একজন নিহত হয়েছেন। যদিও ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে এ মৃত্যুর বিষয়ে এখনো বিস্তারিত কিছু জানায়নি।
ইসরাইলি সেনাবাহিনীর একটি ঘনিষ্ঠ সূত্রকে উদ্ধৃত করে ইসরাইলি আর্মি রেডিও আগে থেকেই সতর্ক করেছিল যে, ইরান রাতেই আবার হামলা চালাতে পারে। তবে সেই সময় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জনগণকে বাসায় ফিরে যেতে এবং আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেই সতর্কতা বাস্তবে রূপ নেয়, এবং শহরের আকাশে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্রের ঝাঁক ছুটে আসে।
ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বেশ কিছু ক্ষেপণাস্ত্র ‘আয়রন ডোম’ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় বাধাগ্রস্ত করা গেলেও, অনেক ক্ষেপণাস্ত্র নিশানায় আঘাত হেনেছে, যা বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়েছে।
ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রে তেমরা শহর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। শহরটির বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় বিস্ফোরণের ফলে গ্যাসলাইন ফেটে যায় এবং বেশ কয়েকটি স্থানে বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটে। অগ্নিনির্বাপক বাহিনী ও জরুরি চিকিৎসাকর্মীরা নিরলসভাবে কাজ করছে।
উত্তর ইসরাইলের কয়েকটি এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, মোবাইল ফোন সংযোগে বিঘ্ন ঘটেছে, ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হচ্ছে। মানুষজন নিজের ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছোটাছুটি করছে।
তেল আবিব ও জেরুজালেমে হামলার পর থেকেই অব্যাহতভাবে বেজে চলেছে বিপদ সংকেতের সাইরেন। রাতের নিকষ আঁধারে সেই শব্দ যেন আরো বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে, বাঙ্কার বা আশ্রয়কেন্দ্রে ঢোকার চেষ্টা করছে।
দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলি বাহিনী, কিন্তু শহরের বাতাসে এখনো বারুদের গন্ধ এবং ধোঁয়ার চাদর। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান-ইসরাইল বিরোধ এখন সরাসরি সামরিক সংঘাতে রূপ নিয়েছে।
এই হামলার পর আন্তর্জাতিক মহলের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া এখনো আসেনি। তবে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আরব লিগ ইতোমধ্যে আগের উত্তেজনার পর শান্তি স্থাপনের আহ্বান জানিয়ে আসছিল। তবে এই সর্বশেষ দফার ভয়াবহ হামলা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইরান-ইসরাইল সংঘাত এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। বিশেষ করে তেল আবিব ও জেরুজালেমের মতো দুটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে একসাথে হামলার ঘটনা স্পষ্ট করছে যে, যুদ্ধ কেবল সীমান্তে নয়—রাজনৈতিক ও বেসামরিক কেন্দ্রগুলোও এখন নিশানায়। সংঘাত আরও বিস্তৃত হলে তা গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে জড়িয়ে ফেলতে পারে, যার ফলাফল হবে বিশ্বব্যাপী কাঁপানো এক নতুন যুদ্ধপরিস্থিতি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ