
ছবি: সংগৃহীত
দেশজুড়ে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ও ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতির প্রেক্ষাপটে ২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা নির্ধারিত সময়ে শুরু হবে কি না—তা নিয়ে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা। পরীক্ষার তারিখ ঘনিয়ে এলেও এখনো পর্যন্ত সরকার বা শিক্ষা বোর্ডগুলোর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরীক্ষা পেছানোর কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি। তবে পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য ঈদুল আজহার পর একাধিক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক বসতে যাচ্ছে, যেখানে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে জানা গেছে।
আগামী ২৬ জুন থেকে শুরু হওয়ার কথা রয়েছে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। শিক্ষা বোর্ডগুলো জানিয়েছে, পরীক্ষার যাবতীয় প্রস্তুতি ইতোমধ্যেই সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রশ্নপত্র, উত্তরপত্র, পরিবহন ব্যবস্থাপনা, কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যবস্থা চূড়ান্ত। তবে করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে নজরে রাখা হচ্ছে এবং সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় একাধিক বিকল্প পরিকল্পনাও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ২৪৭ জন, যাদের মধ্যে মারা গেছেন ৩ জন। যদিও আক্রান্তের হার তুলনামূলকভাবে কম, তবে সাম্প্রতিক কয়েক দিনে সংক্রমণের হার ধীরে ধীরে বাড়ছে।
অন্যদিকে, একই সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৭৩৯ জন এবং মারা গেছেন ২৯ জন। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্ষা মৌসুমে সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে। স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন দপ্তর ও হাসপাতালগুলো এরই মধ্যে রোগী বাড়ার ব্যাপারে সতর্কতা জারি করেছে।
এই দুই রোগের প্রকোপে অভিভাবক ও শিক্ষকেরা বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন, কারণ এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের অনেককেই ঘনবসতিপূর্ণ নগর এলাকায় পরীক্ষা কেন্দ্রে যেতে হয়, যেখানে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করা বেশ কঠিন।
ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এসএম কামাল উদ্দিন হায়দার বলেন, “আমরা যথাসময়ে পরীক্ষা গ্রহণের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। এখন পর্যন্ত পরীক্ষার সময়সূচি অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি। রোববার ঈদের ছুটির পর অফিস খোলার দিন আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেখানে বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিঞা মো. নূরুল হক বলেন, “আলিম পরীক্ষার প্রস্তুতি পুরোপুরি সম্পন্ন হয়েছে। যদি করোনা বা ডেঙ্গুর পরিস্থিতি খুব খারাপ পর্যায়ে চলে যায়, তাহলে সেটি বিবেচনায় নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রোববার আমাদের বোর্ড মিটিং রয়েছে, সিদ্ধান্ত সেখানেই হবে।”
বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রুহুল আমিন বলেন, “কারিগরি শিক্ষা বোর্ড পরীক্ষার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। আজই আমাদের আন্তঃমন্ত্রণালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক রয়েছে। সেখানে সব বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।”
এ বছর এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে ১২ লাখ ৫১ হাজার ১১১ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ছাত্র ৬ লাখ ১৮ হাজার ১৫ জন এবং ছাত্রী ৬ লাখ ৩৩ হাজার ৯৬ জন। তত্ত্বীয় পরীক্ষা শেষ হবে ১০ আগস্ট এবং ব্যবহারিক পরীক্ষা চলবে ১১ থেকে ২১ আগস্ট পর্যন্ত।
এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা সামনে রেখে স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে ভাবছেন অভিভাবকেরাও। নটরডেম কলেজের এক পরীক্ষার্থীর অভিভাবক মিজান মালিক বলেন, “আমরা চাই, দ্রুত একটি করণীয় নির্ধারণ করা হোক। শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে অস্থির হয়ে পড়ছে। নির্দেশনা না থাকলে তারা বিভ্রান্ত হয়ে যাবে। দ্রুত নির্দেশনা প্রকাশ করা দরকার।”
বিভিন্ন কলেজের শিক্ষকরা জানিয়েছেন, তাঁদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা কেন্দ্র থাকায় পরীক্ষার ডিউটি পালন করতে হচ্ছে। কিন্তু ডেঙ্গু ও করোনার বর্তমান পরিস্থিতি তাঁদের উদ্বেগে ফেলেছে। একজন শিক্ষক বলেন, “পরীক্ষা তিন ঘণ্টার হলেও আমাদের সকাল থেকেই কেন্দ্রে থাকতে হয়। পরীক্ষা শুরুর আগে থেকে শেষ হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্র এলাকায় বহু মানুষের ভিড় থাকে, তখন স্বাস্থ্যবিধি মানা কঠিন হয়ে পড়ে। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।”
এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সরাসরি কোনো মন্তব্য না করলেও জানা গেছে, তারা বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সঙ্গে সমন্বয় রেখেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা পেছানো হবে কি না—তা এখনো নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে বোর্ডগুলো তাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে এবং কোনো সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের আগে সরকার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করছে। ঈদের পর আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকের পরই জানা যাবে পরীক্ষার ভবিষ্যৎ।
পরীক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের চোখ এখন সেই বৈঠকের দিকে, যেখানে শুধুমাত্র সংক্রমণ পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করেই নির্ধারিত হবে—পরীক্ষা হবে কি না, আর হলেও নির্ধারিত সময়েই হবে, নাকি কিছুটা পেছাতে হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ