
ছবি: সংগৃহীত
লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক রাজনৈতিক মহলে এক ধরনের স্বস্তি ও প্রত্যাশার জন্ম দিলেও বাস্তবতা কতটা বদলেছে, তা নিয়ে শুরু হয়েছে জোর আলোচনা। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন, বৈঠকের মাধ্যমে একটি প্রাথমিক সমঝোতা হলেও রাজনৈতিক সংকট পুরোপুরি কেটে গেছে বলা যাবে না। বরং এই বৈঠকের মাধ্যমে কিছু নতুন প্রশ্ন ও সম্ভাব্য জটিলতারও জন্ম হয়েছে, যা আগামী দিনে বাংলাদেশের রাজনীতিকে আরও সরু ও পিচ্ছিল পথে নিয়ে যেতে পারে।
প্রতিবেদনে বিবিসি বাংলার সাংবাদিক রাকিব হাসনাত উল্লেখ করেন, এই বৈঠকের পর নির্বাচন নিয়ে সীমিত আলোচনা হলেও এর ব্যপ্তি অনেক বিস্তৃত। শুধু নির্বাচনের সময়কাল নয়, আলোচনায় অংশ নিয়েছে নির্বাচনের পরবর্তী রাজনৈতিক অবস্থা, সরকারের বর্তমান উপদেষ্টাদের অবস্থান, এবং বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের শপথ গ্রহণ সংক্রান্ত ইস্যুগুলোও। তবে আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে যতটুকু আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে, তার বাইরেও অনেক বিষয় আলোচনা হয়েছে বলে বিএনপি ঘনিষ্ঠ সূত্রের দাবি।
যৌথ বিবৃতিতে নির্বাচনের সময়কাল, কিন্তু নিরবতা অন্য বিষয়গুলোতে
বৈঠকের পর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০২৬ সালের রমজানের আগেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। এই ঘোষণাকে সরকার ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে তুলে ধরলেও অনেকেই বলছেন, এ বক্তব্য পুরাতন কথার পুনরাবৃত্তি। কারণ প্রধান উপদেষ্টা এর আগেও এপ্রিল মাসে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে একই সময়সীমা উল্লেখ করেছিলেন।
একই সঙ্গে লন্ডনের বৈঠকের যৌথ বিবৃতিতে জাতীয় নির্বাচন ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করার অঙ্গীকার থাকলেও, সমঝোতার রাজনৈতিক গভীরতা সম্পর্কে পরিষ্কার কিছু বলা হয়নি। বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, এই আলোচনায় আরও অনেক বিষয় আলোচনা হয়েছে, তবে এখনই তা প্রকাশ করা হচ্ছে না। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, আলোচনায় নির্বাচন পরবর্তী শাসনব্যবস্থা এবং সরকারকে কতটা বৈধতা দেওয়া হবে, সে প্রশ্নটিও গুরুত্ব পেয়েছে।
জামায়াত ও এনসিপির আপত্তি: নিরপেক্ষতা প্রশ্নে অনাস্থা
লন্ডনের বৈঠক শেষে একমাত্র বিএনপির সাথেই আলোচনার আনুষ্ঠানিকতা এবং যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করাকে কেন্দ্র করে সমালোচনার মুখে পড়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। জামায়াতে ইসলামী এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, সরকারের পক্ষপাতমূলক আচরণে প্রধান উপদেষ্টার নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তারা বলেছে, প্রধান উপদেষ্টার উচিত ছিল দেশে ফিরে এসে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা।
অন্যদিকে, আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের দল এনসিপি অভিযোগ করেছে, জুলাই সনদ ও বিচারের রোডম্যাপ ঘোষণার আগেই নির্বাচন নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা হয়েছে, যা রাজনৈতিক সংলাপের ধারাবাহিকতায় বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। এনসিপি নেতা আরিফুল হক আদীব বলছেন, আগের দু’দফায় জুলাই সনদের ঘোষণা নিয়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে তারা বিএনপির কাছ থেকে সহযোগিতা আশা করলেও, নির্বাচনের আগেই বিচারের রোডম্যাপ কার্যকর হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন।
‘পর্দার আড়ালে ছাড়পত্র’: নতুন করে প্রশ্ন তুলছে রাজনীতি
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলছেন, বৈঠকে এমন কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে, যার মাধ্যমে বিএনপি কিছু দাবিতে ছাড় দিয়েছে। যেমন, নির্বাচনের নির্ধারিত তারিখ না হওয়া, উপদেষ্টা পদে বিতর্কিতদের ব্যাপারে অনমনীয় অবস্থান ত্যাগ ইত্যাদি। তিনি বলেন, দেড় ঘণ্টার আলোচনায় যদি নির্বাচন তারিখ চূড়ান্তই না হয়, তবে বৈঠকের গোপন কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘সমঝোতা হয়েছে বটে, তবে এতে বিএনপির আন্দোলনের পথ আপাতত বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারও কিছু নিশ্চয়তা পেয়েছে যে বিএনপি আগামী কয়েক মাস রাস্তায় নামবে না।’
অন্যদিকে, অধ্যাপক ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন দাবি করেন, প্রধান উপদেষ্টার নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতেই বিএনপি তিন উপদেষ্টার পদত্যাগ চেয়েছিল এবং সেটি এখনো তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে। তবে লন্ডনের বৈঠকে এই দাবিগুলো সরাসরি আলোচ্য না হলেও, বিএনপির অবস্থান যে নরম হয়েছে তা বিভিন্ন ইঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে।
ইশরাক ইস্যুতে ‘নীরব সমঝোতা’?
ঢাকা দক্ষিণের নির্বাচিত মেয়র ইশরাক হোসেনের শপথ না হওয়া, তার সমর্থকদের অবস্থান কর্মসূচি এবং সরকার পক্ষের নিরব ভূমিকা নিয়ে তীব্র অসন্তোষ ছিল বিএনপিতে। অনেকেই মনে করছেন, এই ইস্যুতে সরকার হয়তো ‘চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে’ পৌঁছেছে এবং সেটি নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকেও আপাতত মুখ বন্ধ রাখা হয়েছে। যদিও বিএনপির শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন, এই দাবি তারা এখনো বহাল রেখেছেন এবং দলের সভায় পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।
আন্দোলন নয়, সমঝোতা
রাজনৈতিকভাবে এই বৈঠকের সবচেয়ে বড় প্রভাব হলো—বিএনপির আন্দোলনের সুযোগ সীমিত হয়ে যাওয়া। সংবাদ বিশ্লেষক মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হলো, আবার সরকার ও বিএনপি একটি রূপরেখায় পৌঁছেছে বলেও ধারণা তৈরি হলো।’
সব মিলিয়ে বলা যায়, লন্ডনের ঐতিহাসিক বৈঠক হয়তো একটি চমকপ্রদ মোড় পরিবর্তনের সূচনা করেছে, তবে এটি সংকট নিরসনের শেষ অধ্যায় কি না, তা সময়ই বলে দেবে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, পরবর্তী রাজনৈতিক রোডম্যাপ, নির্বাচনের নির্ধারিত তারিখ এবং প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে অন্যান্য দলগুলোর সাথে আলোচনা—এই তিনটি বিষয়ে অগ্রগতি না হলে বর্তমান পরিস্থিতি আবারও সংঘাতমুখী হতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ