
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল অধ্যায়ের অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আগামী সোমবার (১৬ জুন) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের শুনানি। এটি দেশে চলমান রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
বিগত বছরগুলোর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ঘটে যাওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সরকারি ব্যক্তির বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। এই মামলার মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিচার নিশ্চিত করা হচ্ছে।
এই মামলায় প্রধান আসামি হিসেবে আনা হয়েছে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-কে। এছাড়াও, মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে।
মোট পাঁচটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনেছেন প্রসিকিউশন পক্ষ, যেগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনের আওতায় পড়ে।
শুনানিটি পরিচালনা করবেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার। গত ১ জুন তিনি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয়ার আদেশ প্রদান করেন এবং অভিযোগ গঠনের বিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য ১৬ জুন দিন ধার্য করেন।
অভিযোগের কাগজপত্র অত্যন্ত বিশাল, যার মধ্যে রয়েছে:
আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র মোট ৮ হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠা।
তথ্যসূত্রের তালিকা ও বিবরণী ২ হাজার ১৮ পৃষ্ঠা।
জব্দকৃত আলামত, দালিলিক প্রমাণাদি ৪ হাজার ৫ পৃষ্ঠা।
শহীদদের তালিকা ও বিস্তারিত বিবরণ ২ হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠা।
এছাড়াও, ৮১ জন সাক্ষী অভিযোগে উল্লেখযোগ্য প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন।
গত ১২ মে চিফ প্রসিকিউটর ওই অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেন। প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই শেষে তা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ হিসেবে গৃহীত হয়। এই মামলাটি হলো গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ সংক্রান্ত প্রথম মামলা, যা ‘মিস কেস’ বা বিবিধ মামলা হিসেবে পরিচিত।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠিত হয়। এই পুনর্গঠনের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমে নতুন উদ্যম এসেছে এবং উল্লেখযোগ্য মামলা গুলো দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়েছে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এই মামলা ছাড়াও ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে আরও দুটি মামলা চলমান রয়েছে। একটি মামলায় আওয়ামী লীগ শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছরের গুম-খুন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। অন্য মামলাটি রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ ধরনের ঘটনা অতীব সংবেদনশীল। এই মামলাগুলো দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ এবং সাধারণ জনগণের মনোভাবের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এই গুরুত্বপূর্ণ শুনানি রাজনৈতিক উত্তেজনা ও বিতর্ককে নতুন মাত্রা দিতে পারে।
বিচার কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ট্রাইব্যুনালকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে বলা হচ্ছে। পাশাপাশি, দেশের মানুষ ও আন্তর্জাতিক মহল অপেক্ষায় রয়েছে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ফলাফলের জন্য।
বাংলাদেশের ইতিহাসে গত কয়েক বছরে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনাবলীর বিচার আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে আরেক ধাপ এগোতে যাচ্ছে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের শুনানি দেশের রাজনৈতিক দিকনির্দেশনায় উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। দেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এ ধরনের কার্যক্রম অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ