
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পোশাক বাজারে জায়গা করে নিতে এক সময় বিশ্বের নানা দেশকে প্রতিযোগিতায় পেছনে ফেলতে হতো বাংলাদেশকে। তবে ২০২৪ সালের প্রথম চার মাসে দৃশ্যপট অনেকটাই বদলে গেছে। তৈরি পোশাক রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধির দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান এখন সবার ওপরে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশে বাংলাদেশি পোশাকের চাহিদা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে—এমনটাই বলছে সর্বশেষ সরকারি তথ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ‘অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেল’ (OTEXA) সম্প্রতি প্রকাশিত হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ২৯৮ কোটি ৩১ লাখ ডলারের পোশাক রফতানি করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৯.৩৩ শতাংশ বেশি। প্রবৃদ্ধির এই হার ভিয়েতনাম, চীন, ভারত, পাকিস্তান এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য পোশাকশিল্প সমৃদ্ধ দেশকেও ছাড়িয়ে গেছে।
প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মোট ২ হাজার ৬২১ কোটি ৮০ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১০.৬৫ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রফতানি করেছে ভিয়েতনাম—৫০৮ কোটি ৯১ লাখ ডলারের পোশাক রফতানি করে তারা প্রথম অবস্থানে রয়েছে। এরপরে রয়েছে চীন, যাদের রফতানি আয় ৪৩৫ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। যদিও চীনের প্রবৃদ্ধি মাত্র ০.৬৬ শতাংশ।
রফতানি আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান এখনো চীন ও ভিয়েতনামের পরে হলেও প্রবৃদ্ধির হার বিবেচনায় বাংলাদেশ এখন শীর্ষে। অর্থাৎ, মার্কিন বাজারে বাংলাদেশি পোশাকের গ্রহণযোগ্যতা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। শুধু ভিয়েতনামের তুলনায়ই নয়, প্রবৃদ্ধির দিক থেকে প্রায় দ্বিগুণ এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।
এই চার মাসে ভারতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২০.৩০ শতাংশ, যা বাংলাদেশের পর দ্বিতীয়। ইন্দোনেশিয়ার প্রবৃদ্ধি ১৫.৬০ শতাংশ, রফতানি আয় ১৬০ কোটি ১১ লাখ ডলার। পাকিস্তান ১৯.৭৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে পৌঁছেছে ১২৩ কোটি ৯ লাখ ডলারে। কম্বোডিয়াও পিছিয়ে নেই—তাদের আয় বেড়েছে ১৯.৫৭ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশের পোশাক রফতানিতে এই রেকর্ড প্রবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে কয়েকটি প্রধান কারণ—
টেকসই উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি: বাংলাদেশ গত কয়েক বছরে পরিবেশবান্ধব ও সবুজ কারখানা স্থাপনায় বিশ্বে নেতৃত্ব দিয়েছে।
বায়ারদের আস্থা বৃদ্ধি: কোভিড পরবর্তী সময়ে সাপ্লাই চেইনের স্থিতিশীলতা ও সময়মতো সরবরাহ নিশ্চিত করায় বাংলাদেশের প্রতি বায়ারদের আগ্রহ বেড়েছে।
সহনীয় উৎপাদন ব্যয় ও প্রতিযোগিতামূলক মূল্য: তুলনামূলকভাবে কম খরচে মানসম্মত পোশাক উৎপাদনের সক্ষমতা বাংলাদেশের অন্যতম শক্তি।
নতুন বাজারে প্রবেশের নীতি: সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য বাজারে রফতানি বাড়াতে নানামুখী কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক তৎপরতা চালানো হচ্ছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)-এর নেতারা বলছেন, “এই প্রবৃদ্ধি কেবল সংখ্যায় নয়, মান ও ধারাবাহিক উন্নতির প্রমাণ। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ আরও বড় জায়গা দখল করতে সক্ষম হবে, যদি সরকার ও ব্যবসায়ী একসঙ্গে কাজ চালিয়ে যায়।”
তারা আরও বলেন, বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে এখন উচ্চমূল্যের পণ্য যুক্ত হচ্ছে, যেমন—স্পোর্টসওয়্যার, ইনটিমেট অ্যাপারেল এবং টেকনিক্যাল টেক্সটাইলস। এই ধরনের পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদা অনেক বেশি।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, যদি এই ধারা বজায় থাকে, তবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই মার্কিন বাজারে রফতানির দিক থেকে বাংলাদেশ আরও একধাপ এগিয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে, বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্যের উদ্ভাবন, দক্ষ শ্রমিক গড়ে তোলা, ট্রেড ডিপ্লোম্যাসি জোরদার এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন অব্যাহত থাকলে এই প্রবৃদ্ধি আরও গতিশীল হবে।
যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের এই সাফল্য নিঃসন্দেহে একটি গর্বের বিষয়। এটি প্রমাণ করে যে, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার মধ্যেও বাংলাদেশ নিজেকে প্রতিনিয়ত দক্ষ, আধুনিক ও নির্ভরযোগ্য রফতানিকারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। উন্নয়নশীল দেশের তকমা থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প এখন বৈশ্বিক মানচিত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ