
ছবি: সংগৃহীত
সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ বাতিলের দাবিতে চলমান আন্দোলনের পটভূমিতে উদ্ভূত সংকট নিরসনে বড় অগ্রগতি হয়েছে। সংশোধিত এই অধ্যাদেশ নিয়ে সরকার যে পুনর্বিবেচনার পথে হাঁটছে, সে ইঙ্গিত দিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। তার নেতৃত্বেই গঠিত উচ্চপর্যায়ের কমিটি আজ সোমবার (১৬ জুন) বিকেলে প্রথম দফা বৈঠকে বসছে। আর তার আগেই আইন উপদেষ্টা জানিয়ে দিলেন—এই আইন “অবশ্যই পুনর্বিবেচনার সুযোগ রাখে”।
সোমবার সচিবালয়ে জাতিসংঘের বলপ্রয়োগে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে গুম সম্পর্কিত কার্যনির্বাহী দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন আইন উপদেষ্টা। সেখানে সরকারি চাকরি সংশোধনী নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, “সরকারি যে চাকরি আইন রয়েছে, সেটার বিষয়ে উপদেষ্টা পরিষদের একাধিক সদস্য—বিশেষত উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানসহ—বলেছেন, এখানে অবশ্যই পুনর্বিবেচনার অবকাশ রয়েছে।”
আসিফ নজরুল আরও বলেন, “আমি বিদেশে ছিলাম বিধায় আইনটি প্রণয়নের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলাম না। তবে যখন আমি পরবর্তীতে আইনটি দেখি, তখন আমার কাছেও মনে হয়েছে—এখানে পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে। শুধু একটা বিষয় আমি জোর দিয়ে বলতে পারি—এই আইনটি সরকারের কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়নি।”
তবে তিনি স্বীকার করেন, আইনটি যথাসময়ে বিশ্লেষণ বা যাচাই না হওয়ার কারণে কিছু বিধান এমনভাবে রয়ে গেছে, যা বাস্তবজীবনে প্রভাবিত কর্মচারীদের কাছে হয়রানি বা বৈষম্যের আশঙ্কা তৈরি করতে পারে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “কোনো কোনো আইনের মধ্যে এমন কিছু থাকতে পারে, যা সেই আইনের ‘সাবজেক্ট’ ব্যক্তিদের কাছে বিব্রতকর মনে হতে পারে। আমরা এটা স্বীকার করি।”
এই অবস্থায় উচ্চপর্যায়ের পর্যালোচনা কমিটি আজ বিকেল ৪টায় প্রথম বৈঠকে বসছে। এ বিষয়ে আসিফ নজরুল বলেন, “সরকারি কর্মচারী ভাইয়েরা যে দাবিগুলো তুলেছেন, সেই কাগজপত্র আমার কাছে রয়েছে। আজকের বৈঠকে আমরা সেগুলো কীভাবে পর্যালোচনা করব, কোন কোন দিক গুরুত্ব পাবে, তা নির্ধারণ করব। এরপর যথাসম্ভব দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমরা একটি সুপারিশমালা উপদেষ্টা পরিষদের সভায় পেশ করব। আমাদের দায়িত্ব প্রস্তাব তৈরি করা, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার আমাদের নয়।”
এ সময় তিনি আন্দোলনরত কর্মচারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আমাদের রিপোর্ট দেওয়ার আগ পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত রাখা হোক। আমরা আন্তরিকভাবে বিষয়টি দেখছি। সব পক্ষকে যুক্ত রেখেই একটি সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছি।”
এদিকে সচিবালয়ে সোমবারও বিক্ষোভ হয়েছে। সরকারি চাকরি সংশোধন অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে সচিবালয় চত্বরে প্ল্যাকার্ড হাতে অবস্থান নেন শত শত সরকারি কর্মচারী। তাদের অভিযোগ, ২০২৫ সালের অধ্যাদেশে এমন কিছু বিধান রাখা হয়েছে, যা সরকারি চাকরিজীবীদের অধিকার ক্ষুণ্ন করে এবং প্রশাসনিকভাবে তাদের ‘নির্বিচারে’ শাস্তির মুখে ঠেলে দিতে পারে।
তাদের ভাষায়, এটি একটি “নিবর্তনমূলক” ও “কালো আইন”। আইনটি বাতিল না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। বিক্ষোভকারীরা বলেন, “যতদিন পর্যন্ত আমাদের দাবি মানা না হবে, ততদিন সচিবালয়ে শান্তিপূর্ণ ও শৃঙ্খলিতভাবে কর্মসূচি চালিয়ে যাব। প্রয়োজনে এই আন্দোলন মাঠ প্রশাসনে ছড়িয়ে দেওয়া হবে।”
এই আন্দোলনের ঢেউ ইতিমধ্যেই বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে পৌঁছে যেতে শুরু করেছে বলে প্রশাসনিক সূত্র জানিয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের কর্মচারীরা সোশ্যাল মিডিয়া এবং হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ব্যাপকভাবে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। অনেক দপ্তরে কর্মী উপস্থিতি কমে এসেছে এবং ফাইল চলাচলে ধীরগতি দেখা দিয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত রমজান মাসের শেষদিকে সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ হঠাৎ করে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। এরপরই দ্রুত কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ঈদের ছুটি শেষে কর্মীরা কর্মস্থলে ফিরে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সচিবালয় চত্বর হয়ে ওঠে বিক্ষোভের কেন্দ্রস্থল।
এই পরিস্থিতিতে সরকার আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের পর্যালোচনা কমিটি গঠন করে। এতে জনপ্রশাসন, আইন ও বিধি বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কমিটিকে স্বল্প সময়ের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।
সরকারি পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, আজকের বৈঠক এবং আসন্ন সুপারিশমালা সরকারের ভবিষ্যৎ অবস্থান নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিশেষ করে যেহেতু আইন উপদেষ্টা নিজেই আইনটির পুনর্বিবেচনার প্রয়োজনীয়তা প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন, তাতে আন্দোলনকারীদের মাঝে আশার সঞ্চার হয়েছে।
এখন নজর সেই বৈঠকে—যেখানে প্রথমবারের মতো আন্দোলনের দাবিগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে পর্যালোচনা করা হবে। সেই বৈঠকের সুপারিশ এবং তার ভিত্তিতে সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপই নির্ধারণ করে দেবে—এই অধ্যাদেশ থেকে পিছু হটবে কি না সরকার। একই সঙ্গে থেমে যাবে কি না সচিবালয়ের বিক্ষোভের ঢেউ।
তবে এ কথা স্পষ্ট যে, সরকারি চাকরি সংশোধন অধ্যাদেশ এখন আর কেবল একটি প্রশাসনিক নথি নয়—বরং তা পরিণত হয়েছে কর্মচারীদের অধিকার ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়ে এক নতুন বিতর্কের কেন্দ্রে। আর সেই বিতর্কের সমাধান হবে কিনা, তা নির্ভর করছে আজকের সেই বৈঠক ও তার ফলাফলের ওপর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ