
ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আশপাশে সোমবার (১৬ জুন) সকালে কয়েক দফা ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এই বিস্ফোরণ ঘটে ঠিক সেই সময়, যখন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার শুনানি হওয়ার কথা ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে ঘটনাটি নিশ্চিত করা হলেও এখনও কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়নি।
সকাল আনুমানিক ৭টার দিকে হাইকোর্ট গেটের বাইরে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা ২টি ককটেল নিক্ষেপ করে। এর একটি বিস্ফোরিত হয় হাইকোর্টসংলগ্ন মাজার গেটের বাইরে, অন্যটি বিস্ফোরিত না হয়ে পড়ে থাকে আব্দুল গনি রোড থেকে দোয়েল চত্বরমুখী রাস্তায়। পুলিশ ও সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, হামলাকারীরা পালাতে সক্ষম হয় এবং বিস্ফোরণের পর ঘটনাস্থলে ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়।
যে মামলার শুনানিকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা ঘটেছে, সেটি বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। এরপর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। নতুন সরকার ‘জুলাই-আগস্ট গণহত্যা’ বলে পরিচিত সেদিনের বর্বর দমনপীড়নের বিচার করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে।
গণআন্দোলনের সময় গণহত্যা, নির্বিচারে হত্যা, নির্যাতন, রাজনৈতিক নিধনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে দায়ের করা হয় প্রথম ‘মিস কেস’ বা বিবিধ মামলা। এই মামলার প্রধান অভিযুক্ত শেখ হাসিনা। তাঁর পাশাপাশি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকেও আসামি করা হয়।
২০২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। এরপর আরও কয়েক মাস তদন্ত শেষে গত ১২ মে তদন্ত সংস্থা আদালতে শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। তদন্তে উঠে আসে, ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমন করতে রাষ্ট্রীয় শক্তিকে বর্বরভাবে ব্যবহার করা হয়, যাতে প্রায় দেড় হাজার মানুষ প্রাণ হারায়, হাজারের বেশি আহত হয় এবং শত শত মানুষ গুম ও গ্রেপ্তার হন।
ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা যায়, ওইদিনের শুনানিতে এই মামলার চার্জ গঠনের বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। তবে এর আগে সকালেই ঘটে বিস্ফোরণের ঘটনা, যা শুনানির নিরাপত্তা প্রশ্নে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
এ বিস্ফোরণকে কেন্দ্র করে জাতীয় রাজনীতিতে উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকেরা। অনেকের মতে, এটি হতে পারে মামলার ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করার একটি কৌশল, আবার কেউ কেউ এটিকে বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী তৎপরতা হিসেবেও বিবেচনা করছেন। যদিও কোনো গোষ্ঠী এখনো এই বিস্ফোরণের দায় স্বীকার করেনি, তবে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টি তদন্তে নেমেছে।
বিস্ফোরণের পরপরই ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) বিপুল সংখ্যক সদস্য ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন এবং ট্রাইব্যুনালের চারপাশ ঘিরে ফেলেন। বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল অবিস্ফোরিত ককটেলটি উদ্ধার করে পরীক্ষা করে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পুরো এলাকা সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় রয়েছে এবং ফুটেজ বিশ্লেষণ করে হামলাকারীদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই বিস্ফোরণের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেক সাধারণ নাগরিক, মানবাধিকারকর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। অনেকে বলছেন, বিচারাধীন একটি মামলার দিনে ককটেল বিস্ফোরণ কোনোভাবেই স্বাভাবিক ঘটনা হতে পারে না। এটি বিচার ব্যবস্থাকে ভয় দেখানোর প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এটি প্রথম নয়, যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ঘিরে সহিংস ঘটনা ঘটল। অতীতেও বিভিন্ন আলোচিত মামলার শুনানির সময় ট্রাইব্যুনাল চত্বরকে লক্ষ্য করে বিক্ষিপ্ত হামলার ঘটনা ঘটেছে। তবে এই মামলাটি এতটাই রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর যে, যেকোনো ধরনের সহিংসতা আদালতের কাজ ব্যাহত করতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইতিহাসের অন্যতম গুরুতর অভিযোগে মামলার শুনানির দিনে এমন বিস্ফোরণ বিচার ব্যবস্থার নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। সরকারপন্থী ও বিরোধী পক্ষ— উভয়ের মধ্যেই উত্তেজনা বাড়ছে। আন্তর্জাতিক মহলের নজর এখন এই মামলার বিচারিক অগ্রগতির দিকে। এর মধ্যেই এমন বিস্ফোরণ আইনি প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক গতি রক্ষা করতে প্রশাসন ও আদালতের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ