
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় দীর্ঘদিনের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে মামলার সংখ্যা এবং বিচারপ্রাপ্তিতে বিলম্ব। দেশের আদালতগুলোতে ঝুলে থাকা লাখ লাখ মামলার কারণে সাধারণ মানুষ যেমন ভোগান্তিতে পড়ছে, তেমনি চাপের মুখে পড়েছে পুরো বিচারিক কাঠামো। এমন পরিস্থিতিতে মামলার অস্বাভাবিক চাপ কমাতে মামলা-পূর্ব বাধ্যতামূলক আপস-মধ্যস্থতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন আইন উপদেষ্টা ও জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার চেয়ারম্যান ড. আসিফ নজরুল।
শনিবার (১৪ জুন) রাজধানীর বেইলি রোডে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার সম্মেলন কক্ষে ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ এর খসড়া উপস্থাপন এবং আলোচনার জন্য আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন আইন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার, আইনজীবী সমিতির নেতারা এবং দেশি-বিদেশি উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরা।
ড. আসিফ নজরুল বলেন, “আদালতে মামলার যে অস্বাভাবিক চাপ, তা শুধু বিচারিক কাঠামো নয়, ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। এই চাপ কমাতে হলে মামলা দায়েরের পূর্বেই আপস-মধ্যস্থতা বাধ্যতামূলক করতে হবে।” তিনি উল্লেখ করেন, প্রতি বছর দেশের আদালতগুলোতে গড়ে পাঁচ লাখের বেশি মামলা দায়ের হয়, অথচ জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয় মাত্র ৩৫ হাজার।
“যেখানে আদালতের মাধ্যমে একটি মামলা নিষ্পত্তিতে গড়ে ৩ থেকে ৫ বছর লেগে যায়, সেখানে লিগ্যাল এইড সেন্টারগুলোতে মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বিরোধ নিষ্পত্তি সম্ভব হচ্ছে—এবং ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই পক্ষগুলো সন্তুষ্ট থাকছে,” বলেন ড. নজরুল।
আইন উপদেষ্টা আরও জানান, “আমরা যদি এই সেবাকে আরও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সমৃদ্ধ, দক্ষ এবং সম্প্রসারিত করতে পারি, তাহলে প্রতিনিয়ত দায়ের হওয়া মামলা কমিয়ে আনা সম্ভব। আগামীতে বছরে ১ থেকে ২ লাখ মামলা আদালতের বাইরে আপসের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে পারলে মামলা দায়েরের সংখ্যা অন্তত ৪০ শতাংশ হ্রাস পাবে।”
তিনি আরও বলেন, “এই লক্ষ্যে আমাদের প্রথম টার্গেট হলো—স্বল্প খরচে ও দ্রুত সময়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। আমরা ইতোমধ্যে দেওয়ানি কার্যবিধিতে বড় পরিবর্তন এনেছি এবং ফৌজদারি কার্যবিধির সংশোধনের কাজও দ্রুত এগিয়ে নিচ্ছি।”
আইন উপদেষ্টা বলেন, “আমাদের দ্বিতীয় টার্গেট হলো—ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। এজন্য আমরা বিচারকদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তাদের জবাবদিহিতা বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছি। ইতোমধ্যে আমরা বিচারকদের ও আইন বিভাগে কর্মরতদের সম্পদের বিবরণী সংগ্রহ করেছি। এগুলোর পর্যালোচনা করে প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তিনি আরও বলেন, “ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে আমরা ডিজিটালাইজেশনের বিষয়েও গুরুত্ব দিচ্ছি। শুধু ফাইলচালিত বিচার নয়, প্রক্রিয়াকে ডিজিটাল এবং ট্র্যাকেবল করতে হবে।”
তৃতীয় লক্ষ্য হিসেবে ড. আসিফ নজরুল বলেন, “মামলার অভিশাপ থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্তি দেওয়াই আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য। এজন্য আমরা আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার কার্যক্রমকে আরও কার্যকর করার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট আইনগুলোতেও প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনছি।”
সভায় প্রস্তাবিত ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর মূল বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করা হয়। প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, পারিবারিক, দেওয়ানি, ক্ষুদ্র ফৌজদারি ও চেকসংক্রান্ত মামলা দায়েরের পূর্বে বাধ্যতামূলকভাবে লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে আপসের চেষ্টা করতে হবে।
এছাড়া জেলার লিগ্যাল এইড অফিসগুলোকে আরও কার্যকর করতে জনবল বৃদ্ধি, অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ ও অভিজ্ঞ আইনজীবীদের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে প্যানেলভুক্তকরণ, এবং ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০’ ও ‘আইনগত সহায়তা বিধিমালা, ২০১৫’ সংশোধনের পরিকল্পনার কথা জানানো হয়।
সভায় অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন জেলা থেকে আসা আইনজীবী ও এনজিও প্রতিনিধিরা এই সংশোধনী উদ্যোগকে সময়োপযোগী বলে অভিহিত করেন। তারা বলেন, “মামলা-পূর্ব আপস বাধ্যতামূলক করা গেলে সাধারণ মানুষের সময়, অর্থ ও মানসিক চাপ অনেক কমে আসবে।”
তারা লিগ্যাল এইড অফিসগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা বাড়ানোর সুপারিশ করেন।
আইন উপদেষ্টা শেষ বক্তব্যে বলেন, “আমরা সব অংশীজনের মতামত চাই এবং সেগুলো বিবেচনায় নিয়েই এই আইন পাস করা হবে। তিন কার্যদিবসের মধ্যে লিখিত সুপারিশ পাঠালে তা সংযুক্ত করে চূড়ান্ত খসড়া জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করব।”
বিচার ব্যবস্থার ভার লাঘব এবং জনগণের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ সহজ করতে মামলা-পূর্ব আপস বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয়। সরকারের এই পদক্ষেপ সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় এক ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ