
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) আয়োজিত ‘রুল অব ল’ বা আইনের শাসন বিষয়ক বার্ষিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে দেওয়া এক ঐতিহাসিক ভাষণে দেশের বিচার বিভাগের জন্য ঘোষিত সংস্কার রোডম্যাপের প্রেক্ষাপট, উদ্দেশ্য ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন।
তিনি বলেছেন, এই রোডম্যাপের মূল লক্ষ্য হলো একটি স্বাধীন, দক্ষ ও জনকেন্দ্রিক বিচারব্যবস্থা গড়ে তোলা, যা শুধু ন্যায়বিচারের প্রতীক নয়, বরং শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং মানবাধিকার রক্ষার শক্ত ভিত হিসেবে কাজ করবে।
সম্মেলনে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন প্রধান বিচারপতি
নিউইয়র্কে ১০ থেকে ১২ জুন পর্যন্ত চলা ইউএনডিপির এই ২৫তম বার্ষিক সম্মেলনে প্রধান বিচারপতি অনলাইনে যুক্ত হয়ে ভাষণ দেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিচার বিভাগের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা এতে অংশ নেন। বক্তব্যে তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা ও জনগণের প্রত্যাশিত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে যে সংস্কার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, সেটি একটি রূপান্তরমূলক এজেন্ডা হিসেবে বিবেচ্য।
তিনি বলেন, “২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশের তরুণদের নেতৃত্বে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান ছিল অন্যায়, স্বেচ্ছাচারিতা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক অভূতপূর্ব গণপ্রতিরোধ। এতে জনগণের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটেছিল। এই প্রেক্ষাপটেই আমি বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ পদে দায়িত্ব গ্রহণ করি। এটি কেবল দায়িত্ব নয়, ইতিহাসের এক বিশাল দায়, যা আমাকে বিচার বিভাগীয় সংস্কারে অঙ্গীকারাবদ্ধ করেছে।”
উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া চ্যালেঞ্জ : ৪২ লাখ মামলার জট ও রাজনৈতিকীকরণ
ড. রেফাত আহমেদ বলেন, “আমি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি ৪২ লাখেরও বেশি মামলার জট, বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের গভীর অবিশ্বাস এবং দীর্ঘদিনের রাজনৈতিকীকরণের ফলে ক্ষয়প্রাপ্ত এক বিচারব্যবস্থা। কিন্তু এসব কোনো কিছুই আমাকে নিরুৎসাহিত করেনি। বরং যারা রাস্তায় নেমেছিলেন ন্যায়ের জন্য, সেই জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়নের দায়িত্ববোধ থেকেই আমি বিচার বিভাগের সংস্কারের রোডম্যাপ ঘোষণা করি।”
তিনি উল্লেখ করেন, রোডম্যাপের মূল লক্ষ্য শুধু মামলার জট কমানো নয়; এটি একটি স্বচ্ছ, স্বাধীন ও দক্ষ বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার রূপরেখা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে আইনের শাসনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে এবং বিচারব্যবস্থাকে জনগণের জন্য সহজপ্রাপ্য করতে হবে।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্ব তুলে ধরেন প্রধান বিচারপতি
প্রধান বিচারপতি তার বক্তব্যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরেন। তিনি জাতিসংঘ, বিশেষ করে ইউএনডিপিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “পরিবর্তনশীল দেশগুলোতে আইনের শাসনের সংস্কারে জাতিসংঘ ও ইউএনডিপি’র কার্যক্রম এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বিচার বিভাগীয় সক্ষমতা, ডিজিটাল রূপান্তর, জনগণ-কেন্দ্রিক পদ্ধতি, প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং সচেতনতা বৃদ্ধিতে ইউএনডিপি আমাদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে কাজ করছে।”
তিনি আরও বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে ট্রানজিশনাল জাস্টিস টুলস নিয়ে সাম্প্রতিক মতবিনিময় তার বিশ্বাসকে পুনরুজ্জীবিত করেছে যে, “রূপান্তরকারী সংস্কারগুলো অন্যায্য ও স্বৈরাচারী শাসন থেকে একটি শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের অন্যতম ভিত্তি হতে পারে।”
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ছাড়া গণতন্ত্র অচল
প্রধান বিচারপতি বলেন, “সাংবিধানিকতা, বৈধতা এবং মানবাধিকারের অভিভাবক হিসেবে বিচার বিভাগের দায়িত্ব অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বিচার বিভাগ নিজে যদি স্বৈরাচারী কবল থেকে মুক্ত না হতে পারে, তাহলে অন্য কোনো রূপান্তরও সম্ভব নয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও জনগণের কাছে তার বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। আমাদের আদালতগুলোকে হতে হবে সত্যিকার অর্থে কার্যকর প্রতিকার প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান।”
তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কেবল একটি সাংবিধানিক শর্ত নয়; এটি একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা, যা গণতন্ত্র, শান্তি এবং ন্যায়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যখন বিচার অনুপস্থিত থাকে, তখন তা রাস্তায় প্রতিফলিত হয়। অতীতের অভিজ্ঞতা আমাদের সেই সত্যই মনে করিয়ে দেয়।”
ন্যায়ের অনুপস্থিতি আন্দোলনের জন্ম দেয়, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাই শান্তির ভিত্তি
প্রধান বিচারপতির মতে, বিচার বিভাগের সংস্কার কেবল প্রশাসনিক বা প্রযুক্তিগত বিষয় নয়, এটি একটি গভীর সামাজিক চুক্তির বাস্তবায়ন। তিনি বলেন, “ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। জনগণ একসময় রাস্তায় নামেই। তাই সময় থাকতে আমাদের উচিত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করা, যেন সমাজে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও মানবাধিকার সুরক্ষিত থাকে।”
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ সংস্কার প্রক্রিয়ায় সঠিক পথে এগোচ্ছে এবং এটি একদিন উন্নত ভবিষ্যতের প্রতীক হয়ে উঠবে। “এটি সব বাংলাদেশি নারী-পুরুষের জন্য হবে এক স্থায়ী আশার আলো,”—এভাবেই বক্তব্য শেষ করেন প্রধান বিচারপতি।
এই সম্মেলনে দেওয়া ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের বক্তৃতা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং বিশ্বব্যাপী রূপান্তরমুখী বিচার ব্যবস্থার জন্য একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে মনে করছেন অনেক বিচার বিশ্লেষক ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ