
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অভিনয় অঙ্গনের পরিচিত মুখ, খ্যাতিমান অভিনেতা সমু চৌধুরীকে বৃহস্পতিবার (১২ জুন) ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার একটি মাজার এলাকা থেকে অস্বাভাবিক ও রহস্যজনক অবস্থায় উদ্ধার করা হলেও তিনি এখনো মাজার ছেড়ে যেতে রাজি নন। বিষয়টি স্থানীয়দের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে, পাশাপাশি উদ্বিগ্ন করেছে দেশের অভিনয় ও সংস্কৃতি জগৎকে।
গফরগাঁও উপজেলার মুখী শাহ্ মিসকিন মাজার এলাকায় দুপুরের দিকে সমু চৌধুরীকে প্রথম দেখা যায়। এলাকাবাসীর ভাষ্য অনুযায়ী, মাজারের পাশের একটি গাব গাছের নিচে তিনি একটি মাদুর পেতে ঘুমিয়ে ছিলেন। তাঁর পরনে ছিল কেবল একটি ছোট গামছা, পাশে পড়ে ছিল একটি পানির বোতল এবং একটি পুতুল। ঘটনাস্থলে উপস্থিত একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, তাঁর অবস্থা অত্যন্ত অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল—গভীর ঘুমে বা অচেতন অবস্থায় ছিলেন কিনা, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না।
অভিনেতা সমু চৌধুরীকে মাজারের গাছতলায় শুয়ে থাকার ছবি মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে। প্রথমে মামুন নামের একজন অভিনয়শিল্পী সমু চৌধুরীর ছবি তুলে নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে পোস্ট করেন। সেখানে তিনি লেখেন, “সমু দাকে আমরা পার্শ্ববর্তী নিরাপদ স্থানে নিয়ে এসেছি। ওনার মানসিক ও শারীরিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে যত দ্রুত সম্ভব ঢাকায় নেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছি। পুরো বিষয়টি অভিনয়শিল্পী সংঘের তত্ত্বাবধানে হচ্ছে।”
এই স্ট্যাটাস ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই অভিনয়শিল্পীদের সংগঠন, নাট্যকারেরা এবং সাধারণ দর্শক-ভক্তরাও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, কীভাবে একজন জাতীয়ভাবে পরিচিত ও অভিজ্ঞ অভিনেতা এমন অবস্থায় নিজেকে একা ফেলে রাখলেন? কেনই বা তিনি নিজ উদ্যোগে মাজারে গেলেন?
বিষয়টি নজরে আসার পর ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন পাগলা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ফেরদৌস আলম। তিনি গণমাধ্যমকে জানান, “সমু চৌধুরী মাজার ছেড়ে কোথাও যেতে চাইছেন না। তিনি বারবার বলছেন, মাজারে এসেছেন মাজারেই থাকবেন।” পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, অভিনেতার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেছেন, “মাজার ভালো লাগে, এখানেই থাকবো।”
পুলিশ আরও জানিয়েছে, সমু চৌধুরীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছে এবং তিনি শারীরিকভাবে সুস্থ আছেন। তবে মানসিকভাবে তিনি কতটা স্থিতিশীল—তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। কারণ স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে হঠাৎ এমন বিচ্ছিন্ন আচরণ মানসিক অস্থিরতারই ইঙ্গিত দেয়।
সমু চৌধুরী কেন হঠাৎ মাজারে চলে গেলেন? কীভাবে তিনি পাগলা থানার মশাখালী ইউনিয়নের এই মাজার এলাকায় পৌঁছালেন? তিনি একা এসেছেন নাকি কারো সঙ্গে—এসব বিষয়ে এখনো কোনো পরিষ্কার তথ্য নেই। তাঁর মোবাইল ফোন খোঁজার চেষ্টা চলছে, কোনো যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করেছেন কিনা তা খতিয়ে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
মাজারের স্থানীয় খাদেম এবং অনুসারীরা জানিয়েছেন, “একজন লোক এসে গাছতলায় চুপচাপ শুয়ে ছিলেন, কিছুক্ষণ পর আমরা চিনতে পারি উনি টিভিতে নাটকে অভিনয় করেন। এরপর এলাকার মানুষ ভিড় করতে শুরু করে।”
সমু চৌধুরীর এমন অবস্থায় অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে শোক ও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। অভিনয়শিল্পী সংঘ জানিয়েছে, তাঁরা তাঁর অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার পর দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছেন যেন তাঁকে ঢাকায় এনে চিকিৎসা ও মানসিক সহায়তা দেওয়া যায়। সংঘের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, “এই ঘটনা আমাদের সবাইকে নাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি একজন সম্মানিত শিল্পী, তাঁকে এভাবে পড়ে থাকতে দেওয়া আমাদের ব্যর্থতা হবে। আমরা চাই সমু ভাই সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন।”
তাঁর আচরণ দেখে অনেকে মনে করছেন, এটি হয়তো কোনো ব্যক্তিগত সংকট, মানসিক ভারসাম্যহীনতা বা আত্মিক কোনোরূপ অনুসন্ধানের ফল হতে পারে। বাংলাদেশের নাট্যজগতে বহু বছরের অভিজ্ঞ এই শিল্পী নিজেকে সম্প্রতি কিছুটা আড়ালে রেখেছিলেন। শোনা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর পরিবারে কিছু সমস্যা ও আর্থিক চাপে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তবে এসব তথ্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, “সমু ভাই একসময় খুব রেগে যান, একসময় আবার খুব নির্লিপ্ত হয়ে যান। গত কয়েক মাসে কারও সঙ্গে ঠিকমতো যোগাযোগও করতেন না।”
স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা প্রয়োজন হলে তাঁকে ঢাকায় ফেরত পাঠাতে সহায়তা করবে, তবে তার আগে তাঁর সম্মতি প্রয়োজন। আর সমু চৌধুরীর পরিবারের কেউ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি। ধারণা করা হচ্ছে, তাঁর পরিবারও তাঁকে ফিরে পেতে চায়, তবে সরাসরি যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে না।
একজন জাতীয়ভাবে খ্যাতিমান অভিনয়শিল্পীর এমন অস্বাভাবিক অবস্থায় গন্তব্যহীন হয়ে মাজারে অবস্থান করা শুধু ব্যক্তি সমু চৌধুরীর বিষয় নয়, বরং এটি বাংলাদেশের শিল্প ও সংস্কৃতি জগতে একটি সংকেত। মানসিক স্বাস্থ্য, আর্থিক নিরাপত্তা ও সামাজিক সহায়তা—এই তিনটি দিকেই এখন আরও বেশি করে নজর দেওয়ার সময় এসেছে।
সমু চৌধুরী কবে ফিরবেন, তিনি আদৌ ফিরে আসবেন কিনা—এই প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা। তবে তাঁর পাশে দাঁড়াতে দেশের অভিনয়পাড়া, মিডিয়া এবং ভক্তদের মানবিক দায়িত্ব রয়েছে, যেটা এখন অনেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করছেন।
এই গল্প কেবল একজন শিল্পীর নয়, এটি একটি সমাজের আত্মিক দরজায় কড়া নাড়ার মতো ঘটনা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ