
ছবি: সংগৃহীত
মসজিদে জামাতের সময় মুসল্লিদের সুশৃঙ্খলভাবে কাতারবদ্ধ হয়ে নামাজ আদায় করা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বর্তমানে অনেক মসজিদে দেখা যায়, কিছু মুসল্লি সামনের কাতার ফাঁকা রেখেই পেছনের কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজে অংশ নিচ্ছেন। বিষয়টি অনেকের কাছে সামান্য মনে হলেও ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে এটি একটি গুরুতর ভুল, যা নাজায়েজ বা অনুচিত হিসেবে বিবেচিত।
ইসলাম কেবল নামাজ আদায়ের প্রতি গুরুত্ব দেয়নি, বরং নামাজের প্রতিটি ধাপ, আদব, শৃঙ্খলা এবং কাঠামোগত বিন্যাসের মধ্যেও একটি বিশেষ সৌন্দর্য ও বিধান রেখেছে। জামাতের নামাজে কাতার সোজা ও পূর্ণ করে দাঁড়ানোকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছেন এবং তার উম্মতকে এ বিষয়ে কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছেন।
সহিহ মুসলিম-এ বর্ণিত একটি হাদিসে সাহাবি জাবির ইবনে সামুরা (রা.) বলেন, “রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের কাছে এলেন এবং বললেন, ‘তোমরা কি সেইভাবে কাতারবদ্ধ হবে না, যেভাবে ফেরেশতারা তাদের রবের সামনে কাতারবদ্ধ হন?’ আমরা বললাম, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! ফেরেশতারা কীভাবে কাতারবদ্ধ হন?’ তিনি বললেন, ‘তারা সামনের কাতারগুলো আগে পূর্ণ করেন এবং কাতারে মিলে মিলে দাঁড়ান।’” (সহিহ মুসলিম, হাদিস ৪৩০)
এই হাদিসে কাতার পূর্ণ করার গুরুত্ব স্পষ্টভাবে বোঝানো হয়েছে। ফেরেশতাদের মতো শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে নামাজে অংশ নেওয়ার নির্দেশনা এসেছে সরাসরি নবী করিম (সা.)-এর পক্ষ থেকে।
অন্য এক হাদিসে আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত আছে: “রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের মধ্যে কাউকে কাতারের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, ‘তোমরা সামনে এগিয়ে এসো এবং আমার অনুসরণ করো। যারা পেছনের কাতারে আছে তারা যেন তোমাদের অনুসরণ করে।’ এরপর তিনি বললেন, ‘এক শ্রেণির লোক থাকবে, যারা সবসময় নামাজে পেছনে থাকবে। আল্লাহও তাদের (তাঁর রহমত, পুরস্কার ও মর্যাদা থেকে) পেছনে রাখবেন।’” (সহিহ মুসলিম, হাদিস ৪৩৮)
এই হাদিসে স্পষ্ট হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হয়েছে তাদের প্রতি, যারা কাতারে পেছনে দাঁড়াতে অভ্যস্ত। আল্লাহ্ নিজেও তাদের ‘পেছনে রাখবেন’—এমন কঠিন বক্তব্য ইসলামী সমাজে নামাজের শৃঙ্খলা রক্ষার গুরুত্বকে বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ হাদিস সুনানে আবু দাউদ (হাদিস ৬৭১)-এ এসেছে। এতে আনাস (রা.) বর্ণনা করেন: “রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা সামনের কাতার পূর্ণ করো, তারপর এর পরের কাতার। যদি কোনো কাতারে অপূর্ণতা থেকেই যায়, তা যেন শেষ কাতারে থাকে।’”
এ হাদিসের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, কাতার পূর্ণ করার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা ও অগ্রাধিকার বজায় রাখতে হবে। প্রথমে প্রথম কাতার, তারপর দ্বিতীয়—এভাবে ধাপে ধাপে কাতার পূরণ করতে হবে। কোনোভাবেই সামনের কাতারে ফাঁকা রেখে পেছনে দাঁড়ানো যাবে না।
ইসলামী ফিকহেও কাতারের এই বিধানকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়েছে। ফাতাওয়া খানিয়া (১/১১৯), রদ্দুল মুহতার (১/৫৭০) এবং অন্যান্য প্রখ্যাত ফিকহি গ্রন্থে উল্লেখ আছে, “সামনের কাতারে জায়গা থাকা সত্ত্বেও কেউ যদি পেছনের কাতারে দাঁড়ায়, তবে তা নাজায়েজ এবং অনুচিত।”
এমনকি কাতারে শৃঙ্খলা রক্ষা করার ফজিলত সম্পর্কেও হাদিসে এসেছে কঠোর সতর্কতা।
হাদিসে আরও এসেছে, “আজান দেওয়া এবং প্রথম কাতারে নামাজ আদায়ের ফজিলত যদি মানুষ জানত, এবং তা পাওয়ার একমাত্র উপায় যদি লটারি হত, তবে মানুষ অবশ্যই লটারির মাধ্যমে তা পেতে চেষ্টা করত।”
(সহিহ বুখারী, হাদিস ৬১৫)
এই হাদিস জানিয়ে দেয়, প্রথম কাতারে নামাজ পড়ার মর্যাদা এতই বড়, যা সাধারণ বুদ্ধিতে পুরোপুরি অনুধাবন করা কঠিন।
সামনের কাতার ফাঁকা থাকা অবস্থায় পেছনে দাঁড়ানো শুধু শৃঙ্খলা ভঙ্গ নয়, বরং ইসলামিক বিধানের বিরুদ্ধে যাওয়ার নামান্তর। এটি একদিকে নাজায়েজ কাজ, অন্যদিকে নামাজের ফজিলত থেকেও বঞ্চনার কারণ।
অতএব, জামাতের নামাজে শরিক হওয়ার সময় মুসল্লিদের উচিত প্রথমে প্রথম কাতার পূর্ণ করা, তারপর ধাপে ধাপে পরের কাতারে দাঁড়ানো। এতে যেমন নামাজ হবে সুন্নাত অনুযায়ী, তেমনি আল্লাহর সন্তুষ্টিও অর্জিত হবে।
আসুন, আমরা সবাই শিখি কিভাবে নামাজে কাতারের শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হয়, এবং তা নিজের জীবনচর্চায় প্রয়োগ করি। তবেই মসজিদের জামাত হবে আরও সুন্দর, শৃঙ্খলাপূর্ণ এবং বরকতময়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ