
ছবি: সংগৃহীত
প্রতি বছরের মতো এবারও পবিত্র হজের মূল স্তম্ভ ‘আরাফার দিবসে’ লক্ষাধিক মুসল্লির অংশগ্রহণে সৌদি আরবের পবিত্র আরাফাতের ময়দানে হজের খুতবা প্রদান করা হয়েছে। ৯ জিলহজ বৃহস্পতিবার, ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ দিনটিতে, ইসলামী চিন্তাবিদ ও মসজিদুল হারামের খতিব শায়খ ড. সালেহ বিন হুমাইদ ঐতিহাসিক মসজিদে নামিরা থেকে এই খুতবা প্রদান করেন। খুতবার ভাষণে উঠে এসেছে ইসলামের মৌলিক বার্তা, আত্মশুদ্ধি, আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, বিশ্ব মুসলিমের ঐক্য এবং নির্যাতিত ফিলিস্তিনি মুসলিমদের প্রতি সহমর্মিতা ও দোয়া।
শায়খ সালেহ বিন হুমাইদ তাঁর খুতবায় মুসলিম জীবনের মূলমন্ত্র স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, আমাদের সবার লক্ষ্য হওয়া উচিত পরিপূর্ণ মুমিন হিসেবে গড়ে ওঠা। এজন্য প্রয়োজন আল্লাহর বিধান মেনে চলা, পূর্ণ আনুগত্য এবং আত্মিক পরিশুদ্ধি। তিনি বলেন, “আল্লাহ তাঁর বান্দাদের নির্দেশ দিয়েছেন কেবলমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্যই জীবন পরিচালনা করতে। আল্লাহ ছাড়া কারও ইবাদত নয়। ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভ—ঈমান, নামাজ, রোজা, জাকাত এবং হজ—পালনের মাধ্যমে একজন মুসলমান প্রকৃতভাবে মুমিন হতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “আল্লাহর প্রতি যারা অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে, আল্লাহ তাদের জন্য জান্নাত নির্ধারণ করে রেখেছেন। আল্লাহ বান্দাদের চায় তাকওয়ার পথে পরিচালিত হোক। আমাদের উচিত প্রতিনিয়ত নিজের গুনাহের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং তাঁর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করা।”
খুতবায় ইসলামী সমাজব্যবস্থার অন্যতম মূলনীতি—ভ্রাতৃত্ববোধ ও আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়। শায়খ সালেহ বলেন, “সমাজের বন্ধন দৃঢ় করতে হলে তোমাদের একে অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার ভিত্তিতে সামাজিক ঐক্য গড়ে তোলা একজন মুসলমানের দায়িত্ব।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন, “ইসলাম কোনো বিচ্ছিন্নতার ধর্ম নয়। এটি একতার, সহমর্মিতার এবং সমষ্টিগত কল্যাণের ধর্ম। হজের এই মহান জমায়েত তারই প্রমাণ।”
হজের খুতবায় আরাফার দিনের তাৎপর্য বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়। শায়খ সালেহ বলেন, “আজ এমন একটি দিন, যেদিন আল্লাহর অগণিত রহমত মানুষের ওপর বর্ষিত হয়। তিনি অসংখ্য মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। এই দিনটি মুসলমানদের জন্য আত্মশুদ্ধির এক মহাসুযোগ। এদিন আরাফাতের ময়দানে হাজিরা দিনভর দোয়া, ইস্তিগফার এবং আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকবেন। তারা এখানে একত্রে জোহর ও আসরের নামাজ আদায় করেন, যা হজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রুকন।”
খুতবার অন্যতম আবেগঘন অংশ ছিল ফিলিস্তিনের নির্যাতিত মুসলমানদের জন্য প্রার্থনা। শায়খ বলেন, “হে আল্লাহ, আপনি ফিলিস্তিনের মুসলিমদের হেফাজত করুন। তাদের ওপর আপনার অনুগ্রহ বর্ষণ করুন। হে আল্লাহ, আপনি তাদের সাহায্য করুন তাদের এবং আপনার শত্রুদের বিরুদ্ধে।” এই প্রার্থনায় আরাফার ময়দানে উপস্থিত লাখো হাজির হৃদয় একত্রে স্পন্দিত হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা মুসলিমদের হজের খুতবার বার্তা পৌঁছে দিতে সৌদি সরকার বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। খুতবাটি বাংলা, ইংরেজি, চাইনিজ, রুশ, তুর্কি, ফরাসি, তামিল, পশতু, রোহিঙ্গাসহ প্রায় ৩৫টি ভাষায় অনুবাদ করে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। এটি ইতিহাসে হজের খুতবা আন্তর্জাতিকভাবে সর্বাধিক অনুবাদ ও সম্প্রচারিত হওয়ার অন্যতম ঘটনা।
আরাফার ময়দানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান শেষে হাজিরা রওনা হন মুযদালিফার দিকে। সেখানে তারা খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়ে একত্রে আদায় করেন মাগরিব ও এশার নামাজ। পরদিন ফজরের নামাজ শেষে তারা মিনার দিকে যাত্রা করেন। মিনার ‘জামারাতে’ হাজিরা ‘শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ’ করবেন—যা হজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়। পরবর্তীতে পশু কোরবানি, চুল কাটা এবং তাওয়াফ ইফাদাহর মাধ্যমে হজের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবে।
বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর সর্ববৃহৎ বার্ষিক জমায়েত হিসেবে হজ শুধু একটি ধর্মীয় অনুশীলন নয়, বরং এটি বিশ্ব মুসলমানদের ঐক্য, সাম্য এবং শান্তির প্রতীক। এ বছরও বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা জাতি, বর্ণ, ভাষা ও সংস্কৃতির পার্থক্য ভুলে এক কাতারে দাঁড়িয়ে ইসলামের এই মহান ফরজ আদায় করছেন।
শায়খ সালেহ বিন হুমাইদের দেওয়া খুতবা বিশ্ব মুসলমানদের কাছে ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শের প্রতিধ্বনি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এটি মুসলমানদের কেবল তাত্ত্বিকভাবে নয়, বাস্তব জীবনেও ইসলামের আদর্শ প্রতিষ্ঠার আহ্বান।
বাংলাবার্তা/এমএইচ