
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ প্রায় দুই বছর বা ২৩ মাস পর পর্যটকদের জন্য সীমিত পরিসরে উন্মুক্ত করা হলো বান্দরবানের অন্যতম দুই জনপ্রিয় পর্যটন উপজেলা রুমা ও থানচি। পাহাড়ি সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিসেবে পরিচিত এসব অঞ্চলে আবারও প্রাণ ফিরতে যাচ্ছে ভ্রমণপিপাসুদের পদচারণায়। শুক্রবার (৬ জুন) থেকে শুরু হচ্ছে সেই প্রত্যাশিত যাত্রা, যা প্রশাসনের এক ঘোষণার মাধ্যমে নতুন করে উদ্দীপনা তৈরি করেছে দেশের ভ্রমণপ্রেমী মানুষের মধ্যে।
দীর্ঘ নিষেধাজ্ঞার অবসান
বান্দরবানের সীমান্তবর্তী পাহাড়ি অঞ্চল রুমা ও থানচি এলাকাকে ঘিরে দীর্ঘ সময় ধরে চলা সন্ত্রাসবিরোধী যৌথ বাহিনীর অভিযানের প্রেক্ষিতে নিরাপত্তা বিবেচনায় ২০২৩ সালের ১৬ মার্চ থেকে পর্যটকদের প্রবেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করে জেলা প্রশাসন। যদিও ২০২৪ সালের ২৩ জুন একবার থানচির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছিল, তবে পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় তা আবারও পুনর্বহাল করা হয়।
সম্প্রতি পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হওয়ায় প্রশাসন নতুন করে পর্যটনের দ্বার উন্মুক্ত করতে উদ্যোগ নেয়। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার (৫ জুন) বান্দরবান জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক শামীম আরা রিনি এক গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেন। এতে ৬ জুন শুক্রবার থেকে রুমা ও থানচি উপজেলায় নির্ধারিত কিছু এলাকা সীমিত পরিসরে ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
কোন কোন জায়গায় যেতে পারবেন পর্যটকেরা?
প্রশাসনের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, থানচি উপজেলায় পর্যটকেরা এখন থেকে নৌপথে তিন্দুমুখ পর্যন্ত এবং সড়কপথে বাকলাই পাড়া হয়ে তমাতুঙ্গী পর্যন্ত ভ্রমণ করতে পারবেন। অন্যদিকে, রুমা উপজেলায় দেশের অন্যতম পরিচ্ছন্ন গ্রাম মুনলাই পাড়া হয়ে পর্যটকেরা যেতে পারবেন রহস্যময় এবং সৌন্দর্যবেষ্টিত বগালেকে। এসব অঞ্চল বরাবরই ভ্রমণকারীদের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে।
তবে এখানেই শেষ নয়—নির্ধারিত এই নির্দিষ্ট এলাকাগুলোর বাইরে এখনও অধিকাংশ অঞ্চলে নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে। জেলা প্রশাসনের ভাষ্য অনুযায়ী, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে এসব জায়গা পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তীতে পুরোপুরি উন্মুক্ত করার চিন্তাভাবনা রয়েছে।
কীভাবে এল এই সিদ্ধান্ত?
বান্দরবান জেলা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও সমন্বয় সংক্রান্ত কোর কমিটির সাম্প্রতিক এক সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। এতে নিরাপত্তা বাহিনী, বিশেষ করে সেনাবাহিনীর ৬৯ পদাতিক ব্রিগেডের মতামতের ভিত্তিতে পর্যটন আংশিকভাবে চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জেলা প্রশাসক শামীম আরা রিনি বলেন, “পর্যটকদের স্বার্থে আমরা সীমিত পরিসরে রুমা ও থানচিতে ভ্রমণের অনুমতি দিচ্ছি। তবে পর্যটকদের উচিত হবে নির্ধারিত গন্তব্যের বাইরে না যাওয়া এবং স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশনা মেনে চলা।”
তিনি আরও বলেন, “যেহেতু এসব অঞ্চলে অতীতে নিরাপত্তা হুমকি ছিল, তাই আমরা চাই না যে পর্যটকদের কারণে আবার কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হোক। সবকিছু ঠিক থাকলে পর্যবেক্ষণ শেষে অন্য দর্শনীয় স্থানগুলোও ধাপে ধাপে খুলে দেওয়া হবে।”
পর্যটনশিল্পে নতুন আশার আলো
নিষেধাজ্ঞার কারণে গত দুই বছর ধরে বান্দরবানের পর্যটন খাত ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছিল। অসংখ্য পর্যটনকেন্দ্রিক হোটেল, গেস্ট হাউস, গাইড এবং পরিবহনসেবার ওপর নির্ভরশীল মানুষ চরম আর্থিক সংকটে পড়েন। তবে এবার সীমিত পরিসরে হলেও পর্যটন চালু হওয়ায় নতুন করে আশায় বুক বাঁধছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় পর্যটন উদ্যোক্তারা বলছেন, “রুমা ও থানচির সৌন্দর্য অতুলনীয়। সেখানে যে কেউ একবার গেলে বারবার যেতে ইচ্ছে করে। এতদিন বন্ধ থাকার কারণে আমাদের ব্যবসা প্রায় ধ্বংসের মুখে ছিল। এখন আবার যদি পর্যটক আসা শুরু করে, তাহলে বেঁচে থাকার একটা উপায় পাওয়া যাবে।”
ভ্রমণকারীদের জন্য পরামর্শ
প্রশাসন সকল পর্যটককে নির্ধারিত এলাকায় ঘুরতে এবং স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে চলাচলের অনুরোধ জানিয়েছে। বিশেষ করে দুর্গম পাহাড়ি পথ ও নৌপথে যাতায়াতের সময় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি এবং সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন, পরিবেশ রক্ষা এবং প্লাস্টিক বা বর্জ্য দূষণ এড়াতে সচেতন থাকার অনুরোধও জানানো হয়েছে।
এই সিদ্ধান্তে দীর্ঘ ২৩ মাস পর নতুনভাবে প্রাণ ফিরে পাবে বান্দরবানের পাহাড়ি পর্যটনশিল্প। আর সেই সঙ্গে দেশের ভ্রমণপ্রেমীরাও ফিরে পাবেন বহু প্রতীক্ষিত তাদের প্রিয় গন্তব্যে ফেরার সুযোগ। তবে সবকিছু নির্ভর করছে একটাই শর্তে—নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেন স্থিতিশীল থাকে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ