
ছবি: সংগৃহীত
সারা বিশ্বের মুসলিমরা যখন কোরবানি ঈদের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, তখন ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ঈদ এসেছে আরেকটি শোকগাথা হয়ে। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা, এশিয়া—প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই ঈদের আনন্দ বইছে; ধনী-গরিব নির্বিশেষে মানুষ ব্যস্ত নতুন জামা-কাপড়, ঈদের বাজার, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মিলনোৎসব আর কোরবানির আয়োজন নিয়ে। কিন্তু এই উচ্ছ্বাসের উল্টো ছবি গাজায়। সেখানে ঈদের নাম শুনলেই চোখে আসে ধ্বংসস্তূপের ছায়া, শোনা যায় ক্ষুধার্ত শিশুর কান্না, আর দেখা যায় কাফনের কাপড় কিনতে ব্যস্ত মানুষের সারি।
ইসরাইলের টানা বিমান হামলা ও অবরোধের ফলে ফিলিস্তিনিরা আজ নরকসম বাস্তবতায় বন্দি। যেদিকে তাকানো যায়, কেবল ধ্বংস, মৃত্যু, ক্ষুধা আর আতঙ্ক। ঈদে গাজায় উৎসব নয়, বরং প্রতিদিনের মতো আরেকটি দিন যেখানে মানুষ বেঁচে থাকাটাই যেন বড় বিস্ময়।
নতুন জামার বদলে কাফনের কাপড়
বছরের এই সময়টাতে গাজায়ও একসময় থাকত ঈদের আমেজ। ঘরে ঘরে জ্বলে উঠত আলোর ঝলকানি, গরু-ছাগলের হাট বসত, শিশুরা হাসিমুখে ঘুরে বেড়াত নতুন জামা পরে। এখন এসব কল্পনারও অতীত। বোমার শব্দে ভোর হয়, রাত কাটে আশ্রয়কেন্দ্রে আর অনাহারে। নতুন জামা কেনা তো দূরের কথা, যাদের আপনজন নিহত হয়েছেন, তারা এখন ঈদের আগে কিনছেন কাফনের কাপড়।
গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে ধ্বংসস্তূপের হৃদয়বিদারক বর্ণনা
গাজার উত্তরাংশের বাসিন্দা নুহা আল-নাজ্জার তার হতাশা আর শোকের কথা বলতে গিয়ে বলেন, “আমাদের ঈদ নেই। চারদিকে কেবল ধ্বংসস্তূপ আর বাচ্চাদের ক্ষুধার কান্না। প্রতিদিন পাশের ঘর থেকে কান্নার শব্দ শুনি, কিন্তু কিছু করতে পারি না। নিজেরাই তো কুরবানি, আমাদের আর কী দেওয়ার আছে?”
গাজার অনেক পরিবার আজ শুধু জীবন বাঁচানোর তাগিদে দিন পার করছে। খাবার নেই, পানির সংকট, ওষুধ নেই—সর্বোপরি নিরাপদ আশ্রয় নেই। কোনো পবিত্র উৎসবই আর তাদের জীবনে খুশি বয়ে আনতে পারছে না।
ত্রাণ কার্যক্রমের নামে প্রহসন, সমালোচনায় ইউনিসেফ
গাজায় চলমান এই দুর্বিষহ মানবিক সংকটের মধ্যেও ইসরাইল খাদ্য ও ওষুধ প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। সামান্য কিছু ত্রাণ ঢুকছে, তাও প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। গত ২৭ মে থেকে সীমিত পরিমাণে কিছু ত্রাণ ঢুকলেও, ইসরাইলি সেনাবাহিনী ত্রাণকেন্দ্রগুলোতে একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। আলজাজিরার তথ্য অনুযায়ী, গত আট দিনে ত্রাণ সংগ্রহে আসা ১০২ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন।
ইসরাইলের দাবি, তারা এখন ‘সংগঠন ও দক্ষতা বৃদ্ধির’ জন্য ত্রাণ বিতরণ সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছে এবং আবার বৃহস্পতিবার থেকে চালু করা হবে। কিন্তু ইউনিসেফের মুখপাত্র জেমস এল্ডার এই কথাকে প্রতারণা হিসেবে অভিহিত করে বলেন, “গাজায় প্রতিদিন ৫০০-৬০০ ট্রাক ত্রাণ ঢোকার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে ঢুকছে ৫০০-৬০০ বাক্স।” তিনি আরও বলেন, “বড় আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলোর কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করে তারা যেসব তথাকথিত সংস্থা দিয়ে ত্রাণ দিচ্ছে, সেগুলো বিশ্ববাসীর সঙ্গে এক ধরনের ভণ্ডামি।”
মানবিক বিপর্যয়ের মুখে জাতিসংঘের প্রস্তাব
গাজার অব্যাহত মানবিক বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ বুধবার রাত ২টায় (বাংলাদেশ সময়) একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের ওপর ভোট দেওয়ার কথা জানায়। তবে একদিকে যখন বৈশ্বিক কূটনৈতিক মহলে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান উঠছে, অন্যদিকে ইসরাইল তার অভিযান অব্যাহত রেখেছে। মঙ্গলবার মধ্যরাতে খান ইউনিসের একটি স্কুলে আশ্রয়কেন্দ্রে চালানো হামলায় ১৮ জন নিহত হন এবং আহত হন আরও ২০ জনের বেশি।
মৃত্যু মিছিলে ঈদ
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলি হামলায় আরও অন্তত ৯৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৪৪০ জন। একদিকে গোটা মুসলিম বিশ্ব ঈদের আগে বাজার, উৎসব, আত্মীয়দের সঙ্গে মিলন নিয়ে আনন্দিত; অন্যদিকে গাজায় চলছে মৃত্যুর মিছিল আর বিদীর্ণ হৃদয় নিয়ে কাফনের কাপড় কিনতে ব্যস্ত পরিবারের হাহাকার।
ভয়াবহ পরিসংখ্যান
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ইসরাইলের হামলায় মোট ৫৪,৬০৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ১,২৫,৩৪১ জন। এ সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। এসব মৃত্যুর বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
ঈদ কোথায়, গাজায় কেবল নীরবতা
ঈদ মানে যেখানে খুশি, মিলন আর ভালোবাসা—গাজায় সেটাই এখন কেবল এক স্মৃতি। রাস্তাঘাট ধ্বংসস্তূপ, হাসপাতাল পরিণত হয়েছে শবঘরে, মসজিদে নামাজের চেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে হাহাকার। বিশ্বের মুসলিমরা আজ যেখানে ঈদের কেনাকাটায় ব্যস্ত, গাজার মানুষ সেখানে স্রেফ বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত। তাদের কাছে ঈদ মানে একবেলা খাবার, একটুখানি নিরাপদ আশ্রয় আর একটু মানবতা। তাদের ঈদে নেই আতশবাজি, নেই খুশির বেলুন—শুধু আছে বোমার শব্দ, ক্ষুধার কান্না আর কাফনের কাপড়ের ওজনে নুয়ে পড়া এক জাতি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ