
ছবি: সংগৃহীত
ঈদুল আজহার আগমনের প্রাক্কালে দেশের অর্থনীতিতে এক টানা সুবাতাস বইছে প্রবাসী আয়ের মাধ্যমে। চলতি বছরের জুন মাসের শুরুতেই প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহে এক নজিরবিহীন ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসের প্রথম মাত্র ৩ দিনেই দেশে এসেছে ৬০ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। যা দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ৭ হাজার ৪২৯ কোটি টাকার সমপরিমাণ (প্রতি ডলার ১২৩ টাকা ধরে)। হিসেব অনুযায়ী, প্রতিদিন গড়ে দেশে আসছে প্রায় ২০ কোটি ১৩ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স—যা দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে ঈদের আগ মুহূর্তে বড় এক শক্তি হিসেবে কাজ করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের জুন মাসের প্রথম ৩ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ২৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার। সেখানে চলতি বছরে একই সময়ে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ কোটি ৪০ লাখ ডলারে, অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১১১ দশমিক ৬০ শতাংশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, ঈদ ঘিরে পরিবারের সদস্যদের কাছে প্রবাসীদের অর্থ পাঠানোর প্রবণতা অনেক বেশি থাকে। এই সময় আত্মীয়স্বজনদের জন্য নতুন পোশাক, উপহার, কোরবানির পশু কেনা ও অন্যান্য খরচের জন্য প্রবাসীরা বাড়তি অর্থ পাঠান। এরই ফলস্বরূপ, এই সময়ে রেমিট্যান্সে বড় উল্লম্ফন দেখা যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, শুধু ৩ জুন দিনেই দেশে এসেছে ১৬ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স। আর গত বছরের জুলাই মাস থেকে চলতি জুন মাসের ৩ তারিখ পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় ১১ মাসে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ৮১১ কোটি ১০ লাখ ডলার। অর্থাৎ, বছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ২৯ দশমিক ৮০ শতাংশ। এই দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের নেয়া নানা পদক্ষেপ—বিশেষ করে হুন্ডি প্রতিরোধ, প্রণোদনা বৃদ্ধি এবং প্রবাসী ফ্রেন্ডলি ডিজিটাল চ্যানেল সম্প্রসারণের সুফল বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত মে মাসেও দেশে এসেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রেমিট্যান্স। ওই মাসে মোট ২৯৬ কোটি ৯৫ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার দেশে এসেছে, যা দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মাসিক রেমিট্যান্স। এর আগে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২৪ সালের মার্চ মাসে, যার পরিমাণ ছিল ৩২৮ কোটি ৯৯ লাখ ৮০ হাজার ডলার। সে মাসে প্রবাসী আয় দেশীয় মুদ্রায় দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৪০ হাজার ১৩৮ কোটি টাকায় (প্রতি ডলার ১২২ টাকা ধরে)। এপ্রিলেও রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল শক্তিশালী—প্রায় ২৭৫ কোটি ১৯ লাখ ডলার এসেছিল। ফেব্রুয়ারিতে ছিল ২৫২ কোটি ৭৬ লাখ এবং জানুয়ারিতে এসেছিল ২১৮ কোটি ৫২ লাখ মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মে মাসের রেমিট্যান্স প্রবাহের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ এসেছে বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে—প্রায় ১৮৭ কোটি ৬২ লাখ ১০ হাজার ডলার। এরপর রয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক, যাদের মাধ্যমে এসেছে ৮১ কোটি ৪৮ লাখ ১০ হাজার ডলার। বিশেষায়িত ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ২৭ কোটি ৩০ লাখ ৭০ হাজার ডলার এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৫৪ লাখ ৮০ হাজার ডলার।
বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি প্রধান স্তম্ভ হলো প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। এই অর্থ প্রবাহ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধ করে, আমদানি ব্যয় নির্বাহে সহায়তা করে এবং সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ভূমিকা রাখে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা চ্যালেঞ্জের মুখেও রেমিট্যান্স প্রবাহ মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। তবে এবারের ঈদে প্রবাসী বাংলাদেশিদের উৎসাহী অর্থ পাঠানোর প্রবণতা পরিস্থিতিকে আরও অনুকূল করে তুলেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আসন্ন কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স পরবর্তী এক সপ্তাহে আরও বাড়বে। ফলে জুন মাসজুড়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে—যা দেশের অর্থনীতির জন্য এক বড় সুখবর।
সরকার ইতোমধ্যে প্রবাসী আয় বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে প্রণোদনা ২.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করার প্রস্তাব, হুন্ডি রোধে নজরদারি বাড়ানো, প্রবাসী ফ্রেন্ডলি ডিজিটাল অ্যাপ ও চ্যানেল চালু করা এবং বৈধ পথে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে ব্যাংক ও মোবাইল আর্থিক সেবাদানকারীদের সঙ্গে সমন্বয় বৃদ্ধি। এসব উদ্যোগ চলমান থাকলে রেমিট্যান্সের ইতিবাচক ধারা আগামী মাসগুলোতেও অব্যাহত থাকবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সার্বিকভাবে বলা যায়, ঈদের আগে প্রবাসী আয় প্রবাহে যে গতি সৃষ্টি হয়েছে, তা দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে স্বস্তির বার্তা নিয়ে এসেছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ