
ছবি: সংগৃহীত
এবারের কুরবানির ঈদ রাজনীতিতে এনে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে উদযাপিত দ্বিতীয় ঈদ এটি, এবং তাৎপর্যপূর্ণভাবে এটি উদযাপন করা হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে অনেকটাই মুক্ত ও ভীতিমুক্ত পরিবেশে। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনীতির মাঠে বাড়তি উত্তাপ তো রয়েছেই, সেই সঙ্গে ঈদের সময়টাকেই কাজে লাগাতে শুরু করেছেন রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা।
ঈদুল আজহার ছুটিকে কেন্দ্র করে সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকায় যাচ্ছেন। ভোটারদের কাছে পৌঁছাতে তাঁরা এই সময়টিকে কাজে লাগাচ্ছেন সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়ন এবং জনসংযোগ বাড়াতে। কোথাও কুরবানির পশু দান, কোথাও ঈদ উপহার বিতরণ, আবার কোথাও নির্বাচনের গুরুত্ব বোঝাতে জনগণকে সচেতন করাসহ নানা উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে।
বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি, এনসিপি এবং অন্যান্য বিরোধী দলগুলোর নেতা-কর্মীরা তাদের প্রচারণা জোরদার করেছেন। মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও বাড়ছে যোগাযোগ। ঈদের দিন ঈদের নামাজ শেষে অনেকেই তাদের এলাকার গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন।
২০২৩ সালের আন্দোলনে গুম-খুনের শিকার নেতা-কর্মীদের পরিবারে উপহার পৌঁছানো, সহানুভূতি জানানো এবং ঈদের আনন্দে তাদের পাশে থাকা—এসব কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে রাজনীতিকরা নিজেদের দায়বদ্ধতাও দেখাতে চাচ্ছেন। শুধু বিএনপি নয়, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মগুলোও এই মানবিক কৌশলকেই তাদের নির্বাচনি কর্মকৌশলের অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছে।
ঈদুল আজহায় ঢাকায় থাকবেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। দীর্ঘ সাত বছর পর মুক্ত পরিবেশে ঢাকায় তার নিজ বাসা ফিরোজায় তিনি আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ঈদ করবেন। ভার্চুয়ালি যুক্ত হবেন তারেক রহমান ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে, যারা এবার ঈদ পালন করবেন যুক্তরাজ্যে।
দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, ডা. জাহিদ হোসেন—এঁরা ঢাকায় ঈদ করবেন এবং পরবর্তীতে নিজ নিজ এলাকায় জনসংযোগে যাবেন।
অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে মির্জা আব্বাস শাহজাহানপুরে, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কেরানীগঞ্জে, আব্দুল মঈন খান নরসিংদীর পলাশে, আমির খসরু চট্টগ্রামে, সালাহউদ্দিন কক্সবাজারে, টুকু সিরাজগঞ্জে এবং আরও অনেকে নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকায় ঈদ উদযাপন করবেন।
দলীয় প্রতীক ফিরে পাওয়ার আশা এবং নিবন্ধন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের আশাবাদী বার্তার পর জামায়াতের সম্ভাব্য প্রার্থীরাও জোরেশোরে মাঠে নেমেছেন। আমির ডা. শফিকুর রহমান নিজ জেলা মৌলভীবাজারে ঈদ করবেন, নায়েবে আমিরগণ এবং কেন্দ্রীয় নেতারা যার যার এলাকায় ঈদ পালন করবেন। সৌদি আরবে অবস্থানরত নেতারাও আছেন তালিকায়, যারা হজ উপলক্ষে অবস্থান করছেন।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিরা ঢাকা, রংপুর, পঞ্চগড়, কুমিল্লা, ভোলা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, রাজবাড়ী, ফেনীসহ নানা জায়গায় ঈদ করবেন এবং ভোটের বার্তা ছড়িয়ে দেবেন।
ইসলামী আন্দোলনের পীরসাহেব চরমোনাই ও মহাসচিব খুলনায় ঈদ করবেন। এলডিপির কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না এবং গণঅধিকার পরিষদের নেতারাও স্থানীয় জনগণের সঙ্গে ঈদের উৎসব ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন, যা এক ধরনের 'ভোট প্রি-প্রেপ' হিসেবেই দেখা হচ্ছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের চোখে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ঈদের এই সময়টি নির্বাচনপূর্ব ‘সফট ক্যাম্পেইন’-এর মোক্ষম সুযোগ। গত দেড় দশকের দমন-পীড়নের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে নেতা-কর্মীরা এবার যে স্বস্তির ঈদ করছেন, সেটি তাদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা জাগিয়েছে। তবে একই সঙ্গে মির্জা ফখরুলের সতর্কতা—"আচরণে যেন কেউ কষ্ট না পায়"—এটিও দলের কৌশলগত পরিপক্বতার ইঙ্গিত দেয়।
কুরবানির ঈদ ঘিরে রাজনীতির মাঠে নতুন করে যে উত্তাপ ছড়িয়েছে, তা একদিকে গণতন্ত্রের ফিরতি হাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে, অন্যদিকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বপ্রস্তুতির অংশ হিসেবেও চিহ্নিত হচ্ছে। ঈদের আমেজে রাজনৈতিক দলগুলোর কৌশলী তৎপরতা প্রমাণ করে, ভোটের লড়াই শুরু হয়ে গেছে—তবে তা এখনো 'ঈদ মোড়কে' মোড়ানো।
বাংলাবার্তা/এমএইচ