
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদ শুরুর কয়েক দিনের মাথায় বহুল আলোচিত এবং বিতর্কিত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার একটি সম্প্রসারিত সংস্করণ অনুমোদন করেছেন। বুধবার (৪ জুন) তিনি এক ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করে ১২টি দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। একই সঙ্গে আরও সাতটি দেশের ওপর আংশিক ভ্রমণ বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
নতুন নিষেধাজ্ঞার আওতায় যেসব ১২টি দেশের নাগরিকদের সম্পূর্ণভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেগুলো হলো—আফগানিস্তান, বার্মা (মিয়ানমার), চাদ, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি, ইরিত্রিয়া, হাইতি, ইরান, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান এবং ইয়েমেন। এদের মধ্যে বেশিরভাগ দেশেই রাজনৈতিক অস্থিরতা, জঙ্গি তৎপরতা এবং দুর্বল প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা কাঠামো বিরাজ করছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তথ্য বিনিময় ও যাচাইয়ে অনাগ্রহী হওয়া এবং পরিচয় যাচাইয়ের যথাযথ প্রক্রিয়া না থাকার কারণেও এসব দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে বলে হোয়াইট হাউস জানিয়েছে।
আংশিক নিষেধাজ্ঞা আরোপিত ৭টি দেশ হলো—বরুণ্ডি, কিউবা, লাওস, সিয়েরা লিওন, টোগো, তুর্কমেনিস্তান এবং ভেনেজুয়েলা। এই দেশগুলোর ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট ক্যাটাগরির ভিসা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়েছে, আবার কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত যাচাইয়ের মাধ্যমে ভ্রমণ অনুমতি দেওয়া হবে।
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র অ্যাবিগেল জ্যাকসন এক্স-এ (সাবেক টুইটার) পোস্ট করে জানিয়েছেন, "আমেরিকানদের নিরাপত্তা রক্ষা করতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার প্রতিশ্রুতি পূরণে অবিচল রয়েছেন। কিছু বিপজ্জনক বিদেশি সত্তা এবং রাষ্ট্র আমাদের দেশে ঢোকার চেষ্টা করছে, যাদের সঙ্গে আমাদের নিরাপত্তার স্বার্থে আপস করার কোনো সুযোগ নেই।"
তিনি আরও বলেন, "এই নিষেধাজ্ঞাগুলো কোনো জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয় বরং এসব দেশের প্রশাসনিক দুর্বলতা, ভিসা-ওভারস্টে প্রবণতা, পরিচয় যাচাইয়ের ব্যর্থতা এবং অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা তথ্য বিনিময়ের কারণেই আরোপ করা হয়েছে।"
যুক্তরাষ্ট্র সরকার জানিয়েছে, এই নিষেধাজ্ঞা ইতোমধ্যে যারা যুক্তরাষ্ট্রের বৈধ স্থায়ী বাসিন্দা (গ্রিনকার্ডধারী) অথবা বৈধ ভিসাধারী—তাদের ওপর প্রযোজ্য হবে না। তাছাড়া ‘জাতীয় স্বার্থে’ যারা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে চান, তাদের ক্ষেত্রেও বিশেষ ছাড় দেওয়া হতে পারে। অর্থাৎ চিকিৎসা, জরুরি মানবিক সহায়তা, কূটনৈতিক কার্যক্রম কিংবা গুরুত্বপূর্ণ সরকারি চুক্তির আওতায় যারা আসবেন, তারা এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বেন না।
ট্রাম্প প্রশাসনের এই নতুন ঘোষণা অনেকটা তার প্রথম মেয়াদে দেওয়া বিতর্কিত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার ধারাবাহিকতায় এসেছে। ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সাতটি দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন, যা ব্যাপক আইনি লড়াই এবং সমালোচনার মুখে পড়ে। তবে সে সময় সুপ্রিম কোর্ট একটি সংশোধিত নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখার অনুমোদন দেয়। পরে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২০২১ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর ক্ষমতায় এসেই ট্রাম্পের সেই ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে দেন।
বর্তমান নিষেধাজ্ঞাটি তুলনামূলকভাবে আরও বিস্তৃত এবং দেশভিত্তিক তথ্য যাচাই ও নিরাপত্তা আদান-প্রদানের সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে তৈরি করা হয়েছে বলে দাবি করছে হোয়াইট হাউস। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির কৌশলগত পুনরায় প্রণয়ন হিসেবে এটি দেখা হচ্ছে।
এই নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার সময় ট্রাম্প প্রশাসন আরও একবার জানিয়ে দিয়েছে যে তারা অভিবাসন ইস্যুতে আগের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর অবস্থানে রয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম চার মাসে দক্ষিণ সীমান্তে নজরদারি বাড়িয়েছেন এবং ভিসা কার্যক্রমেও নতুন কিছু বাধা আরোপ করেছেন। বিশেষ করে মধ্য আমেরিকা ও আফ্রিকার কিছু দেশের বিরুদ্ধে ভিসা প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি এবং যাচাই জোরদার করা হয়েছে।
তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং অভিবাসন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এই নিষেধাজ্ঞা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের ভাষ্য মতে, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা সাধারণ জনগণকে শাস্তি দেওয়ার নামান্তর, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তির পরিপন্থী।
এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের আবেদন করা ব্যক্তিদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর অসহায় মানুষ যারা শরণার্থী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় চাইতে চেয়েছিলেন, তাদের সামনে এখন অন্ধকার ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বসবাসকারী অভিবাসন অধিকারকর্মী এবং আইনি সংস্থাগুলো ইতোমধ্যে এই নিষেধাজ্ঞা চ্যালেঞ্জ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে এটি নিয়ে আইনি লড়াই শুরু করতে পারেন বলে ইঙ্গিত মিলেছে।
সবমিলিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ আবারও অভিবাসন ইস্যুকে মার্কিন রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। নির্বাচনী বছর ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের সিদ্ধান্ত তার রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবেও বিবেচনা করছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ