ছবি: সংগৃহীত
কার্লো আনচেলত্তি—ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সফল কোচ, যিনি ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলে ভিন্ন ভিন্ন দেশের শীর্ষ ক্লাবগুলোকে চ্যাম্পিয়ন বানিয়েছেন। এবার তিনি প্রথমবারের মতো দায়িত্ব নিয়েছেন একটি জাতীয় দলের, তাও আবার ফুটবল ঐতিহ্যের অন্যতম ধ্বজাধারী ব্রাজিলের! বাংলাদেশ সময় আগামী শুক্রবার ভোর ৫টায় ইকুয়েডরের বিপক্ষে ২০২৬ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচ দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সেলেকাওদের ডাগআউটে নামছেন এই ইতালিয়ান গুরু।
৬৫ বছর বয়সী আনচেলত্তির কোচিং ক্যারিয়ারে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে এই ম্যাচ দিয়ে। কিন্তু বিশ্বকাপজয়ী দেশের দায়িত্ব নেয়া মানে শুধু মাঠে ১১ জন খেলোয়াড়কে পরিচালনা করা নয়; এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কোটি সমর্থকের আবেগ, ইতিহাসের চাপ এবং ভবিষ্যতের প্রত্যাশা। তাই সেলেকাওদের কোচ হিসেবে আনচেলত্তির সামনে যাত্রা শুরুর মুহূর্তেই রয়েছে পাঁচটি বড় ও জটিল চ্যালেঞ্জ—যেগুলো পার করতে না পারলে ষষ্ঠ বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।
১. বিশ্বকাপে খেলা নিশ্চিত করাই প্রথম ধাপ
আনচেলত্তির ব্রাজিল অধ্যায়ের প্রথম ও সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো ২০২৬ বিশ্বকাপে দলের যোগ্যতা নিশ্চিত করা। দক্ষিণ আমেরিকার কঠিন বাছাইপর্বে লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে ১০টি দেশের মধ্যে। এই অঞ্চল থেকে সরাসরি ছয়টি দল বিশ্বকাপে জায়গা পাবে। এখন পর্যন্ত ১৪ ম্যাচে ২৪ পয়েন্ট নিয়ে চতুর্থ স্থানে রয়েছে ব্রাজিল। তাই ইকুয়েডর ও প্যারাগুয়ের বিপক্ষে আসন্ন ম্যাচ দুটিতে জয় তুলে নিতে পারলেই আনচেলত্তির দল নির্ভারভাবে বিশ্বকাপে যাওয়ার টিকিট নিশ্চিত করতে পারবে।
এই ম্যাচ দুটি শুধু পয়েন্ট টেবিলের জন্য নয়, আনচেলত্তির আত্মবিশ্বাস এবং দলের মধ্যে আস্থা তৈরি করতেও গুরুত্বপূর্ণ। যাত্রার শুরুতেই ব্যর্থতা হলে তার ওপর চাপ বহুগুণে বেড়ে যাবে। আর তা হলে ব্রাজিলিয়ান মিডিয়া ও সমর্থকদের সমালোচনার তীর এক মুহূর্তও দেরি করবে না তাকে বিদ্ধ করতে।
২. বিশ্বমানের সেন্টার ফরোয়ার্ডের খোঁজে
ব্রাজিলের ফুটবল ইতিহাসে রোনালদো, রোমারিও, বেবেতো কিংবা কাফুর মতো ফরোয়ার্ডদের নাম স্মরণ করলেই শিহরণ জাগে। কিন্তু বর্তমানে দলে তেমন কেউ নেই, যাকে দেখে বলা যায়—এটাই সেই বিশ্বমানের নাম্বার নাইন, যিনি বিপক্ষ ডিফেন্স চুরমার করে দিতে পারেন। এখন পর্যন্ত আক্রমণভাগ মূলত ভিনিসিয়ুস জুনিয়র ও রাফিনিয়ার কাঁধেই ভরসা করছে, যারা উইঙ্গার হিসেবে বেশি কার্যকর।
অথচ আনচেলত্তির সিস্টেমে একটি কার্যকরী সেন্টার ফরোয়ার্ড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন পর্যন্ত এই পজিশনে ভরসা করা হচ্ছে রিচার্লিসনের ওপর। কিন্তু তার সাম্প্রতিক ফর্ম আশানুরূপ নয়। গোল করার ধারাবাহিকতা হারানো রিচার্লিসনের ওপর নির্ভর করাটা একটি ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত হতে পারে। তাই আনচেলত্তিকে খুব দ্রুতই বিকল্প কাউকে খুঁজে বের করতে হবে—হয়তো যুব একাডেমি থেকে, হয়তো ইউরোপে খেলা নতুন কোনো ব্রাজিলিয়ান প্রতিভাকে তুলে এনে।
৩. মাঝমাঠে সৃষ্টিশীলতার সংকট কাটানো
আধুনিক ফুটবলে খেলার গতি ও কৌশল নির্ধারণ করে মাঝমাঠ। সেই জায়গায় ব্রাজিল বর্তমানে খুব দুর্বল। বিশেষ করে সৃষ্টিশীল মিডফিল্ডারের ঘাটতি স্পষ্ট। যেখানে রিয়াল মাদ্রিদে থাকাকালে আনচেলত্তি ভরসা করতেন টনি ক্রুস বা লুকা মদরিচের মতো প্লেমেকারদের ওপর, সেখানে ব্রাজিল দলে তেমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন।
ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে কাসেমিরো থাকলেও আক্রমণ সংগঠনের কাজে তার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ব্রুনো গিমারায়েস, লুকাস পাকেতা কিংবা আন্দ্রে সান্তোসের মতো কিছু সম্ভাবনাময় খেলোয়াড় থাকলেও কেউই এখনো বিশ্বমানের প্লেমেকারের জায়গায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। এই অবস্থায় আনচেলত্তিকে হয়তো নতুন কাউকে গড়ে তুলতে হবে, কিংবা বর্তমানদের মধ্য থেকে কাউকে ভিন্নভাবে ব্যবহার করতে হবে—যাতে দল সৃষ্টিশীলতার ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে পারে।
৪. দুর্বল রক্ষণভাগকে রূপান্তর করতে হবে অভেদ্য দেয়ালে
বিশ্ব ফুটবলে ব্রাজিল মানেই আক্রমণাত্মক, চোখধাঁধানো ফুটবল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই দলটি রক্ষণভাগে ভুগছে সবচেয়ে বেশি। ডিফেন্সিভ লাইন বারবার প্রতিপক্ষের আক্রমণে ভেঙে পড়ছে। বিশেষ করে ফুলব্যাক পজিশনে মানসম্পন্ন খেলোয়াড়ের অভাব আছে।
অতীতে ব্রাজিলের ডিফেন্স মানে ছিল কাফু, রবার্তো কার্লোস, লুসিও বা থিয়াগো সিলভার মতো খেলোয়াড়। বর্তমান দলে এমন ভারসাম্যপূর্ণ, গতিময় এবং আক্রমণ-রক্ষণে সমান দক্ষ ডিফেন্ডারের সংকট দেখা দিয়েছে। আনচেলত্তিকে তাই এই দুর্বলতাকে শক্তিতে রূপান্তর করতে হবে। অভিজ্ঞদের সঙ্গে নতুন মুখ মিশিয়ে একটি সুসংগঠিত রক্ষণভাগ গড়ার দিকেই তাকিয়ে থাকতে হবে কোচকে।
৫. সমর্থকদের হৃদয় জয় করা, ফুটবলের সৌন্দর্য ফেরানো
সবশেষ কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—ব্রাজিলের ফুটবল মানে শুধুই জয় নয়, এটি এক ধরনের শিল্প, যা মানুষ উপভোগ করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রাজিল তাদের ঐতিহ্যগত ‘জোগো বোনিতো’—অর্থাৎ ‘সুন্দর খেলা’—ধারা হারিয়ে ফেলেছে। পরপর দুটি বিশ্বকাপে ব্যর্থতা, কোপা আমেরিকায় ছন্দপতন এবং একঘেয়ে রক্ষণাত্মক কৌশল—সব মিলিয়ে সমর্থকরা ব্রাজিল দল থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
আনচেলত্তির সামনে তাই শুধু জয়ের লক্ষ্যে দল গঠন করলেই চলবে না, তাকে এমন একটি দল গড়তে হবে যেটি চোখে লাগে, যেটি মাঠে বল পায়ে শিল্প রচনা করে এবং প্রতিপক্ষকে ট্যাকটিকস দিয়ে নয়, খেলায় মুগ্ধ করে হারায়। এটাই ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের ঐতিহ্য। সমর্থকদের মন জয়ের চেয়ে বড় অর্জন সম্ভবত জাতীয় দলের জন্য আর কিছুই হতে পারে না।
বিশ্বকাপের আগে সময় হাতে খুব বেশি নেই। কিন্তু অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে কার্লো আনচেলত্তির জুড়ি নেই। তার কৌশলী মন, নেতৃত্বগুণ এবং জয়ী মানসিকতা যদি সঠিকভাবে কাজে লাগে, তাহলে হয়তো ব্রাজিল আবার সেই পুরনো জয়ের পথে ফিরতে পারবে। তবে তার জন্য এই পাঁচটি চ্যালেঞ্জেই আনচেলত্তিকে প্রথম জয়ী হতে হবে। এরপরই আসবে ষষ্ঠ বিশ্বকাপ জয়ের পথে সাফল্যের সম্ভাবনা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



