
ছবি: সংগৃহীত
জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ সময়। আল্লাহতায়ালা এই দিনগুলোকে বান্দার নিকটবর্তী হওয়ার এক বিশেষ সুযোগ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। এই দিনগুলোতে ইবাদত-বন্দেগি, তাসবিহ-তাহমিদ, তিলাওয়াত, দান-সদকা এবং নফল রোজাসহ বিভিন্ন আমলের প্রতি উৎসাহিত করেছেন কোরআন ও হাদিসে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ দিন হল ইয়াওমে আরাফা, অর্থাৎ ৯ জিলহজ—এই দিন রোজা রাখার ব্যাপারে এসেছে বিশুদ্ধ হাদিসসমূহে প্রবল উৎসাহ ও বড় ফজিলতের ঘোষণা।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আমি আশা করি, আরাফার দিনে রোজা রাখা বিগত এক বছর ও আগাম এক বছরের গুনাহ মোচনের কারণ হবে।”
— সহীহ মুসলিম, হাদিস: ১১৬২; বর্ণনাকারী: আবু কাতাদা (রা.)
অন্যদিকে, হজরত হাফসা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, “রাসুলুল্লাহ (সা.) জিলহজের ৯ তারিখ এবং আশুরার দিনে রোজা রাখতেন।”
— সুনানে আবু দাউদ, নাসায়ী, মুসনাদে আহমাদ
বিখ্যাত হাদিস বিশারদ আল্লামা শামসুল হক আযীমাবাদী মুবারকপুরী (রহ.) বলেন, “এই হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, নবীজি জিলহজের ৯ তারিখ রোজা রাখতেন। এ দিনটিই ‘ইয়াওমে আরাফা’। এটি ৮ তারিখ নয়, বরং হিজরি ক্যালেন্ডার অনুসারে প্রত্যেক অঞ্চলের ৯ জিলহজ।”
— মিন্নাতুল মুনইম, ২/২১১
অনেকের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দেয়, সৌদি আরবের হাজীরা যেদিন আরাফাতে অবস্থান করেন (৮ জিলহজ আমাদের দেশে), সেদিন কি আমরা রোজা রাখব? এ নিয়ে যেসব মত পাওয়া যায়, তার মধ্যে মূলধারার ইসলামি চিন্তাবিদ, ইমামগণ ও উলামায়ে কেরামের সর্বসম্মত অভিমত হলো—আরাফার রোজা রাখতে হবে নিজ নিজ দেশের চাঁদ দেখে নির্ধারিত ৯ জিলহজ তারিখে।
এই দিনে রোজা রাখার ফজিলত ‘আরাফায় অবস্থানের’ সঙ্গে যুক্ত নয়, বরং এটি জিলহজ মাসের ৯ তারিখের ফজিলতপূর্ণ আমল। এদিন হাজীদের জন্য আরাফায় অবস্থান ফরজ হলেও, অন্যান্যদের জন্য রোজা রাখা সুন্নত। সুতরাং বাংলাদেশের জনগণের জন্য আরাফার দিন হচ্ছে বাংলাদেশের হিসেব অনুযায়ী ৯ জিলহজ।
‘ইয়াওমে আরাফা’ শব্দটি কেবল হজরত আরাফার ময়দানে উপস্থিতির দিন বোঝায় না। বরং এটি হিজরি ক্যালেন্ডারের ৯ জিলহজ তারিখের একটি ধর্মীয় নাম, যেটি কিয়ামত পর্যন্ত এভাবেই বহাল থাকবে। যেমনিভাবে ঈদুল আযহার দিনকে বলা হয় ‘ইয়াওমুন নাহর’ (কুরবানির দিন) এবং তা ১০ জিলহজ।
যদি কেউ আরাফার দিনকে সৌদি আরবের সঙ্গে মিলিয়ে ৮ জিলহজ ধরে নেয়, তাহলে সে বাস্তবে ৯ তারিখের ফজিলত ও ঐতিহ্য লঙ্ঘন করছে, এবং ঈদের দিনের ধারাবাহিকতাও বিঘ্নিত হয়। কারণ এতে ঈদের দিন ১১ তারিখে পড়ে যাবে, যা ইজমা বা উম্মাহর ঐকমত্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
‘তাকবিরে তাশরিক’ হলো— "আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ"
— এটি পড়া শুরু হয় ৯ জিলহজ ফজর থেকে এবং চলে ১৩ জিলহজ আসরের পর পর্যন্ত।
হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত— “নবীজি ইয়াওমে আরাফা ফজরের পর থেকে ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত তাকবিরে তাশরিক পাঠ করতেন।”
— মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদিস: ৫৬৭৭
এ হাদিসে স্পষ্টভাবে ‘ইয়াওমে আরাফা’ বলতে ৯ জিলহজকেই বোঝানো হয়েছে। তাকবিরে তাশরিক একটি সর্বজনস্বীকৃত আমল, এবং তার শুরু ৯ তারিখ থেকেই। তাই আরাফার দিন ৮ তারিখ হলে তো তাকবিরে তাশরিক শুরু হতো একদিন আগে! কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি, বরং ৯ তারিখেই তা শুরু হয়।
সমগ্র মুসলিম উম্মাহর মধ্যে এই ব্যাপারে ঐকমত্য (ইজমা) রয়েছে যে,
৯ জিলহজ হচ্ছে ইয়াওমে আরাফা
১০ জিলহজ হচ্ছে ইয়াওমুন নাহর (কুরবানির দিন)
আরাফার রোজা পালন করতে হবে নিজ দেশের হিজরি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৯ জিলহজ তারিখে।
এ ইজমার বিপরীত কোনো বক্তব্য বা প্রচারণা শুধু বিভ্রান্তিই ছড়ায় না, বরং তা ইসলামী শরিয়াহর মৌলিক নিয়মকেও লঙ্ঘন করে। ফিকহের দৃষ্টিতে, এমন বিচ্ছিন্ন মত গ্রহণ করা শরীয়তের নির্ভরযোগ্য উৎস ও দলিলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ স্বরূপ।
এ বছরের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের আকাশে চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ৯ জিলহজ পড়ছে আগামী শুক্রবার, ইনশাআল্লাহ। তাই এ দিনেই রাখুন আরাফার রোজা—যার ফজিলত এতই বেশি যে, তার বিনিময়ে আল্লাহতায়ালা এক বছর আগের ও এক বছর পরের গুনাহ মাফ করে দেন।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই মহান ফজিলতের দিনে রোজা রাখার তাওফিক দিন। আমিন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ