
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা আবারও তুঙ্গে উঠেছে জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচি ঘিরে। ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শুক্রবার (৬ জুন) জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক আনুষ্ঠানিক ভাষণে তিনি এই সময়সীমা নির্ধারণের কথা জানান। তবে এ ঘোষণাকে মোটেও ইতিবাচকভাবে নেয়নি অন্যতম প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। বরং ড. ইউনূসের বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দলটির শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়ে যায় এবং এতে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে অনড় থাকার সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় স্থায়ী কমিটির জরুরি ভার্চুয়াল বৈঠকে দলটির শীর্ষ নেতারা বলেন, দেশের জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হলে আর বিলম্ব নয়—চূড়ান্ত সময়সীমা হতে হবে ডিসেম্বর ২০২৫। বৈঠকে অংশ নেওয়া সদস্যরা মনে করেন, ড. ইউনূসের ঘোষিত সময়সীমা অনাবশ্যক বিলম্বের প্রতিফলন, যা দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আরও দীর্ঘায়িত করবে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় জনগণের আস্থা ক্ষুণ্ণ করবে।
বিএনপির নেতারা উল্লেখ করেন, ডিসেম্বরের পরবর্তী সময়টি আবহাওয়াগত দিক থেকে অনুকূল নয়। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত দেশে কুয়াশা, শীত ও অতিরিক্ত ঠান্ডার কারণে নির্বাচনী প্রচারণা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাছাড়া এপ্রিল মাসজুড়ে রমজান মাস হওয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে যথাযথ নির্বাচনী প্রস্তুতি, জনসংযোগ এবং প্রচারণা চালানো বাস্তবিকভাবেই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
বিএনপির মতে, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সময় ঘোষণা করলেও, কেন ডিসেম্বরের আগে নির্বাচন আয়োজন সম্ভব নয়—সে বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট যুক্তি বা তথ্য তার ভাষণে তুলে ধরেননি। দলটির নেতারা মনে করছেন, এই বিলম্বের পেছনে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতার অভাব এবং একটি বিশেষ রাজনৈতিক মহলের অপতৎপরতাই দায়ী।
বিএনপি তাদের বিবৃতিতে সরাসরি অভিযোগ করে বলেছে, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত ছিল দেশের সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য সময়সীমায় নির্বাচন আয়োজনের রূপরেখা তৈরি করা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, একটি বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রভাবে অন্তর্বর্তী সরকার নিজেদের নিরপেক্ষতা হারাচ্ছে এবং অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের মতামতকে উপেক্ষা করছে।”
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “নিরপেক্ষ সরকার গঠনের মূল লক্ষ্যই ছিল দেশের জনগণকে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন উপহার দেওয়া। কিন্তু যদি সেই সরকারই নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় সিদ্ধান্ত নেয় এবং নির্বাচনকে বিলম্বিত করে, তাহলে জনগণের মধ্যে এই প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা গড়ে উঠবে না। বরং সাধারণ মানুষ এটিকে একটি নতুন ধরনের রাজনৈতিক প্রতারণা হিসেবে দেখবে।”
বিএনপির নেতারা এটাও মনে করছেন যে, বিলম্বিত নির্বাচনের ফলে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়বে। বিদেশি বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
দলের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে বিএনপি সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, ‘অহেতুক সময়ক্ষেপণ’ পরিহার করে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় দেশের রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে এবং তাতে কেউই লাভবান হবে না।
বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি এই মুহূর্তে একটি রাজনৈতিক কৌশলগত অবস্থান নিচ্ছে, যেখানে তারা নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার ও নির্বাচন কমিশন উভয়ের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে চাইছে। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিকে সামনে রেখে তারা নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে চাইছে এবং মাঠপর্যায়ে নতুন করে আন্দোলনের প্রস্তুতিও নিচ্ছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
অপরদিকে, অন্তর্বর্তী সরকার এখনও কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে খোলামেলা সংলাপে বসেনি বলেও সমালোচনার মুখে রয়েছে। ড. ইউনূসের ভাষণে ‘ঐক্যমতের ভিত্তিতে নির্বাচন আয়োজনের’ যে কথা বলা হয়েছে, বিএনপি ও তার মিত্ররা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছে এবং বলছে, “এটি কেবল কাগুজে কথা, বাস্তবে নয়।”
এই প্রেক্ষাপটে ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন ঘিরে রাজনৈতিক টানাপোড়েন যে আরও বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য। সামনে হয়তো আন্দোলন, প্রতিরোধ এবং রাজনৈতিক চাপ আরও দৃশ্যমান হবে। জনগণের প্রত্যাশা, অন্তর্বর্তী সরকার সব পক্ষকে নিয়ে একটি বাস্তবভিত্তিক, গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে অগ্রসর হবে—যেখানে দেশের স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র এবং ভোটের অধিকার সবার আগে গুরুত্ব পাবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ