
ছবি: সংগৃহীত
মুসলমানদের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। এই দিনটি সারা বিশ্বের মুসলমানদের জন্য কেবল আনন্দ আর উদযাপনের সময় নয়, এটি ত্যাগ ও আত্মনিবেদনের মহান শিক্ষা বহন করে। কিন্তু ফিলিস্তিনের নিরস্ত্র জনগণের জন্য এবারের ঈদ এসেছে এক ভয়ংকর মৃত্যুযজ্ঞের রূপ নিয়ে। গাজার বিস্তীর্ণ এলাকায় ঈদের নামাজের সময় যখন অন্যত্র মুসলমানরা কুরবানি ও আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত, তখন দখলদার ইসরাইলি বাহিনীর বর্বর হামলায় রক্তাক্ত হয়েছে গাজার পবিত্র ভূমি।
ঈদের দিন অর্থাৎ শুক্রবার (৭ জুন ২০২৫) সকাল থেকেই গাজা উপত্যকার বিভিন্ন স্থানে ধারাবাহিক বিমান ও গোলাবর্ষণ হামলা চালায় ইসরাইলি সামরিক বাহিনী। গাজার জরুরি উদ্ধার ও অগ্নিনির্বাপক সংস্থা ‘সিভিল ডিফেন্স’-এর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বার্তাসংস্থা এএফপিকে জানিয়েছেন, ইসরাইলি বাহিনীর দফায় দফায় হামলায় অন্তত ৩৮ জন নিহত হয়েছেন।
তিনি জানান, সবচেয়ে ভয়াবহ হামলাটি চালানো হয় উত্তর গাজার জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে। সেখানে একটি আবাসিক ভবনে সকালবেলা চালানো বোমা হামলায় কমপক্ষে ১১ জনের মৃত্যু হয়। ঘটনাস্থল থেকে আহত অবস্থায় অনেককেই টেনে বের করতে দেখা গেছে, যেখানে শিশুরা পর্যন্ত ইসরাইলি আগ্রাসনের বলি হয়েছে। আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক, ফলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে শঙ্কা করা হচ্ছে।
তবে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা হাসপাতাল সূত্রের বরাত দিয়ে জানায়, শুক্রবার সকালের ইসরাইলি হামলায় মোট ৪২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। শুধু জাবালিয়ায় নয়, খান ইউনিস, দেইর আল-বালাহ এবং রাফাহ অঞ্চলেও একাধিক হামলা চালানো হয়েছে।
খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালের এক কর্মকর্তা জানান, গাজার দক্ষিণাঞ্চলের রাফাহর পশ্চিম ও উত্তর এলাকায় অবস্থিত দুটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে চালানো গোলাবর্ষণে কমপক্ষে সাতজন ফিলিস্তিনি নিহত হন। এদের মধ্যে নারী ও শিশুও ছিল। বেসামরিক মানুষের জন্য চালু হওয়া এই ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলো ইসরাইলের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
তবে শুধু শুক্রবারের হামলাই নয়, চলমান যুদ্ধে ত্রাণ গ্রহণ করতে গিয়ে ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। গাজার সরকারি গণমাধ্যম দপ্তর জানিয়েছে, বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে অংশ নিতে গিয়ে এখন পর্যন্ত ইসরাইলি হামলায় ১১০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। উল্লেখ্য, এই সংস্থাটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের যৌথ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত, যা প্রথম থেকেই বিতর্কিত ছিল।
এই ভয়াবহ তথ্য সামনে আসার পর জিএইচএফ শুক্রবার ঘোষণা দিয়েছে, গাজায় আপাতত সব ধরনের ত্রাণ কার্যক্রম বন্ধ রাখা হবে। যদিও মানবিক পরিস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে, তারপরও নিরাপত্তার অভাবে তারা কার্যক্রম স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছে।
ফিলিস্তিনি অধিকার সংস্থাগুলো বলছে, ইসরাইল এই যুদ্ধকে যেন প্রতিহিংসার মহড়ায় পরিণত করেছে। ঈদের মতো ধর্মীয় পবিত্র দিনেও ইসরাইল থেমে থাকছে না। এর মাধ্যমে তারা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনকে প্রকাশ্যে অগ্রাহ্য করছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোও এ ধরনের হামলার নিন্দা জানিয়ে চলেছে। তবে কোনো শক্ত পদক্ষেপ এখনো নেয়া হয়নি, যা আন্তর্জাতিক মহলের নিষ্ক্রিয়তা ও পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান নিয়েও নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
ফিলিস্তিনি জনগণ যখন দুর্ভিক্ষ, রোগব্যাধি ও নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছে, তখন ঈদের দিনও তাদের জীবনে আশার কোনো আলো আসেনি। বরং আগত দিনগুলোতে নতুন করে হামলার আশঙ্কা আরও বাড়ছে। গাজার হাসপাতালগুলোতে ওষুধ, জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও চিকিৎসা সামগ্রীর তীব্র সংকট চলছেই।
অন্যদিকে ঈদুল আজহা উপলক্ষে ইসলাম ধর্মের শিক্ষা অনুযায়ী, মুসলমানরা ত্যাগ ও সহমর্মিতার মাধ্যমে সমাজে শান্তি ও সাম্য প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়। কিন্তু ইসরাইলি আগ্রাসন ফিলিস্তিনিদের জন্য এই পবিত্র দিনের সব মূল্যবোধকে যেন পদদলিত করে দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্ব ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছে ফিলিস্তিনিদের প্রাণরক্ষায় জরুরি ও কার্যকর হস্তক্ষেপ এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। মানবতার এই চরম লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে নীরবতা আর গ্রহণযোগ্য নয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ