
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের উত্তপ্ত প্রেক্ষাপটে দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে সম্প্রতি এক গুরুত্বপূর্ণ ফোনালাপ হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত এ টেলিফোন সংলাপকে বিশ্ব অর্থনৈতিক অঙ্গনের বিশ্লেষকরা দেখছেন একটি সম্ভাব্য ইতিবাচক মোড় হিসেবে। চীনের ওয়াশিংটন দূতাবাস এক বিবৃতিতে নিশ্চিত করেছে, এই আলোচনাটি ট্রাম্পের অনুরোধে অনুষ্ঠিত হয়েছে। যদিও দুই পক্ষের কেউই আলোচনা বিষয়ে বিস্তারিত জানায়নি, তবে এটি যে বাণিজ্য সংকট নিরসনের উদ্দেশ্যে হয়েছে, তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির এই দ্বন্দ্ব গত কয়েক মাস ধরে বৈশ্বিক পণ্যবাজার, বিনিয়োগ ও রাজনীতিতে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের মতে, এই ফোনালাপ এমন এক সময় অনুষ্ঠিত হলো, যখন কয়েক সপ্তাহ আগেই দুই দেশ একটি অস্থায়ী শুল্ক হ্রাস চুক্তি করলেও তা নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। মে মাসে জেনেভায় অনুষ্ঠিত এক দীর্ঘ আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সিদ্ধান্ত নেয়, পরবর্তী ৯০ দিনের জন্য একে অপরের ওপর আরোপিত উচ্চ হারে শুল্ক হ্রাস করা হবে। চুক্তির আওতায়, যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক ১৪৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনবে এবং চীনও পাল্টা শুল্ক ১২৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে কমাবে।
তবে এই আলোচনার কিছুদিন পরই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অভিযোগ করেন, চীন পূর্ব প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করেছে এবং নির্ধারিত শুল্ক হ্রাস কার্যকর করেনি। বিষয়টি নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করে এবং বিশ্লেষকরা ধারণা করতে শুরু করেন যে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যচুক্তি সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়তে পারে। এর মধ্যেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শি জিনপিংকে ফোন করে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেন, যার ফলস্বরূপ এই টেলিফোন সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্লেষকদের মতে, এটি নতুন করে আলোচনার পথ উন্মোচন করতে পারে।
চীনের রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির কাঠামো, অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা ফেন্টানিলের সরবরাহ বন্ধে ব্যর্থতা, এবং যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট তাইওয়ানকে ঘিরে চীনের আগ্রাসী অবস্থান—এসব ইস্যু দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নতুন করে জটিলতা সৃষ্টি করেছে। এছাড়াও, চীন সম্প্রতি মূল্যবান খনিজ ও চুম্বক রপ্তানিতে হঠাৎ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর ফলে, বিশ্বের গাড়ি প্রস্তুতকারী, চিপ নির্মাতা ও সামরিক প্রযুক্তিপণ্য সরবরাহকারীদের মধ্যে কাঁচামাল সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। অনেকেই মনে করছেন, চীন এটি একটি কৌশলগত চাপ প্রয়োগের উপায় হিসেবে ব্যবহার করছে।
একই সঙ্গে, ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে চীনের বেশ কিছু সফটওয়্যার ও প্রযুক্তিপণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, যার মধ্যে চীনের চিফ ডিজাইন সফটওয়্যার অন্যতম। একইসঙ্গে ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপ বেইজিং ক্ষোভের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হঠাৎ সিদ্ধান্ত ও ঘোষণায় আন্তর্জাতিক বাজার ও কূটনৈতিক মহলে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। কখনো হঠাৎ করে কঠোর বাণিজ্য নীতির ঘোষণা দেন, আবার কখনো শেষ মুহূর্তে তা প্রত্যাহার করে নেন। এ ধরণের অস্থিরতা বিশ্বের নেতাদের ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আস্থার ঘাটতির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে চীন বরাবরই বলে আসছে, উচ্চপর্যায়ের যেকোনো আলোচনার আগে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ও কাঠামোগত সুনির্দিষ্টতা জরুরি। অন্যদিকে, ট্রাম্প প্রশাসনের মতে, জটিল সমস্যার সমাধানে শীর্ষ নেতাদের সরাসরি সংলাপই হতে পারে কার্যকর পথ।
এই ফোনালাপের মাধ্যমে দুই পক্ষই হয়তো আবারো আলোচনায় ফিরতে আগ্রহী, তবে এর বাস্তব রূপ দেখা যাবে ভবিষ্যতের নীতিগত পদক্ষেপে। দুই দেশের সর্বশেষ শীর্ষ পর্যায়ের সাক্ষাৎ হয়েছিল ২০১৯ সালে জাপানের ওসাকায় এক সম্মেলনে। পরে ২০২৩ সালের নভেম্বরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান এবং প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে সামরিক যোগাযোগ পুনরায় চালু করা এবং যুক্তরাষ্ট্রে ফেন্টানিল প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে চীন ওয়াদা দেয়।
বিশ্লেষকদের মতে, সাম্প্রতিক ফোনালাপটিকে হয়তো একক কোনো বড় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না, তবে এটি একটি বড় বাণিজ্য বিরোধ মীমাংসার সম্ভাব্য সূচনা হতে পারে। এখন দেখার বিষয়, ট্রাম্প ও শি জিনপিং এই আলোচনার ভিত্তিতে পরবর্তী সময় কী ধরনের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বিশ্ব অর্থনীতির দিকনির্দেশনার জন্য এ সিদ্ধান্তগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ