
ছবি: সংগৃহীত
দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম আবারও বেড়েছে। চলতি বছরের নানা অর্থনৈতিক টানাপোড়েন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় এই দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)। বৃহস্পতিবার (৫ জুন) রাতে বাজুস এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নতুন দাম কার্যকরের বিষয়টি নিশ্চিত করে। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, শুক্রবার (৬ জুন) থেকেই নতুন এই মূল্যহার কার্যকর হয়েছে।
স্থানীয় বাজারে তেজাবি স্বর্ণের দাম বৃদ্ধিই মূল কারণ
বাজুস জানিয়েছে, স্থানীয় বাজারে তেজাবি স্বর্ণের—অর্থাৎ বিশুদ্ধ পিওর গোল্ডের—মূল্য বেড়ে যাওয়ায় এই মূল্য সমন্বয়ের প্রয়োজন পড়ে। স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম বাড়ার পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও কাঁচা স্বর্ণ সংগ্রহের খরচ বেড়ে গেছে। ফলে বাধ্য হয়েই দেশজুড়ে স্বর্ণের মূল্য হালনাগাদ করতে হয়েছে।
বাজুসের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বৃহস্পতিবার বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিংয়ের এক বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যবৃদ্ধি, স্থানীয় চাহিদা ও সরবরাহ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সর্বসম্মতিক্রমে স্বর্ণের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
নতুন দামের তালিকা
এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেশের বাজারে এখন স্বর্ণের নতুন মূল্যহার দাঁড়িয়েছে—
২২ ক্যারেট হলমার্ককৃত প্রতি গ্রাম স্বর্ণ: ১৪,৭৭৫ টাকা
২১ ক্যারেট হলমার্ককৃত প্রতি গ্রাম স্বর্ণ: ১৪,১০৩ টাকা
১৮ ক্যারেট হলমার্ককৃত প্রতি গ্রাম স্বর্ণ: ১২,০৮৮ টাকা
এছাড়া তেজাবি স্বর্ণের দাম বৃদ্ধির সঙ্গেও সামঞ্জস্য রেখে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বাজার বিশ্লেষকদের মতে, দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে গয়না কেনার পরিকল্পনায় এই মূল্যবৃদ্ধি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আন্তর্জাতিক বাজারেও ঊর্ধ্বগতি
বাংলাদেশে দাম বাড়ার পাশাপাশি বিশ্বের অন্যতম বড় স্বর্ণের বাজার দুবাইতেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। খালিজ টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে দুবাইয়ের স্বর্ণের বাজারে নতুন করে চাঙাভাব সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বৃহস্পতিবার (৫ জুন) সকাল থেকেই বাজার খোলার সঙ্গে সঙ্গে সব ধরনের স্বর্ণের দামে ঊর্ধ্বগতি দেখা যায়।
দুবাই জুয়েলারি গ্রুপের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী:
২৪ ক্যারেট স্বর্ণ: ৪০৬ দিরহাম প্রতি গ্রাম (আগের দিন ছিল ৪০৪.৫ দিরহাম)
২২ ক্যারেট স্বর্ণ: ৩৭৬ দিরহাম
২১ ক্যারেট স্বর্ণ: ৩৬০.৫ দিরহাম
১৮ ক্যারেট স্বর্ণ: ৩০৯ দিরহাম
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে ঈদুল আজহা সামনে রেখে স্বর্ণের চাহিদা প্রতিবছরই বাড়ে। এই সময়টায় উপহার ও বিয়ের জন্য প্রচুর স্বর্ণ কেনাবেচা হয়। ফলে এই মৌসুমী চাহিদার চাপও আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
বাংলাদেশের বাজারে প্রভাব
দেশে সাধারণত আন্তর্জাতিক বাজারের দামের ওপর নির্ভর করে স্বর্ণের মূল্য হ্রাস-বৃদ্ধি নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ডলার সংকট, আমদানিতে জটিলতা ও কর কাঠামোর জটিলতার কারণে অনেক ব্যবসায়ী বিদেশ থেকে স্বর্ণ আমদানির পরিবর্তে স্থানীয়ভাবে তেজাবি স্বর্ণ সংগ্রহের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠেছেন। এর ফলে স্থানীয় বাজারে পিওর গোল্ডের দামের ওপর সরাসরি প্রভাব পড়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকদের মতে, “বাংলাদেশে স্বর্ণ এখন আর শুধু অলংকার নয়, বরং একটি বিকল্প বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হচ্ছে। বিশেষ করে দেশের মুদ্রার মূল্যহ্রাস ও ব্যাংক খাতের অনিশ্চয়তার সময়ে অনেকেই স্বর্ণ কিনে ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় রাখছেন। ফলে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দামও বাড়ছে।”
সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া
নতুন দামের ঘোষণায় স্বর্ণ ক্রয় নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে যারা ঈদ বা বিয়ের মৌসুমে গয়না কেনার পরিকল্পনা করেছিলেন। ঢাকার বঙ্গবাজার, নিউমার্কেট, চট্টগ্রামের জামালখান ও খুলনার শিববাড়ী এলাকার স্বর্ণব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেকেই দোকানে গিয়ে দাম শুনে ফিরে যাচ্ছেন।
এক ক্রেতা বলেন, “মেয়ে বিয়ের জন্য কিছু স্বর্ণ কিনবো ভাবছিলাম, কিন্তু এখনকার দামে সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না। এমনিতে জীবনযাত্রার খরচ বেড়েই চলেছে, তার ওপর আবার স্বর্ণের এমন দাম!”
ভবিষ্যৎ বাজার পরিস্থিতি
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যদি আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কমে আসে এবং দেশের ডলার সংকট কিছুটা স্বাভাবিক হয়, তবে স্বর্ণের দাম কিছুটা হ্রাস পেতে পারে। তবে ঈদুল আজহার আগে সেই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। বরং ঈদের পর নতুন করে দাম পুনর্বিবেচনার সুযোগ থাকতে পারে।
সবমিলিয়ে বলা যায়, বর্তমানে স্বর্ণের দাম বাড়া একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব, অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরীণ সংকটের প্রতিফলন। ফলে এ পরিস্থিতিতে স্বর্ণ কেনার আগে সাধারণ ক্রেতাদের আরও সতর্ক থাকা ও বাজার পরিস্থিতি ভালোভাবে বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ