
ছবি: সংগৃহীত
আজ বাংলাদেশের আকাশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ঈদুল আজহার খুশির বারতা। ঈদ মানেই খুশি, ঈদ মানেই ভালোবাসা, আর ঈদুল আজহা মানেই সেই খুশি ও ভালোবাসার সঙ্গে ত্যাগ ও উৎসর্গের এক মহিমান্বিত মেলবন্ধন। বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানের মতো বাংলাদেশের প্রতিটি শহর, গ্রাম, মহল্লা ও গঞ্জ আজ আনন্দ ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে পরিপূর্ণ।
ঈদুল আজহার মূল বার্তা হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আত্মোৎসর্গ এবং ত্যাগ। ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ এ উৎসবে মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি দেন, যা তাঁদের ঈমান, সহানুভূতি ও সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠার প্রতীক। এই দিনে ধনী-গরিব, শক্তিশালী-দুর্বল, রাজনীতিক-জনতা সবাই এক কাতারে ঈদগাহে নামাজ আদায় করেন। এমনকি কেউ যদি কোরবানি না-ও দিতে পারেন, ইসলামের শিক্ষা অনুসারে তার ঘরেও মাংস পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নেন অন্য ভাই-বোনেরা।
ঈদের জামাত ও ত্যাগের ঐক্য
ভোরের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের লাখো মুসল্লি নতুন পোশাক পরে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঈদগাহে ছুটে যান। ঢাকা শহরের প্রতিটি ওয়ার্ড, উপশহর, মহল্লা ও অলিগলিতে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। তবে জাতীয় ঈদগাহ মাঠে অনুষ্ঠিত প্রধান জামাতকে কেন্দ্র করে রাজধানীজুড়ে তৈরি হয় ভিন্ন এক আবহ।
জাতীয় ঈদগাহে আজ সকাল সাড়ে ৭টায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে ঈদুল আজহার প্রধান জামাত। এ জামাতে অংশ নিচ্ছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিবৃন্দ, প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বসহ সর্বস্তরের মুসল্লিরা। ইমামতি করছেন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতিব মুফতি মোহাম্মদ আবদুল মালেক।
তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বৃষ্টির আশঙ্কা থাকলে এই জামাত জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে সকাল ৮টায় অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া বায়তুল মোকাররমে যথারীতি পাঁচটি ঈদের জামাত হবে যথাক্রমে সকাল ৭টা, ৮টা, ৯টা, ১০টা ও ১০টা ৪৫ মিনিটে।
বিশাল জামাতের ঐতিহ্য
প্রতিবছর দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় কিশোরগঞ্জ জেলার শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে। এবারও সকাল ৯টায় এই ঐতিহাসিক মাঠে জামাত অনুষ্ঠিত হবে। ইমামতি করবেন শহরের বড় বাজার জামে মসজিদের খতিব মাওলানা আবুল খায়ের মো. সাইফুল্লাহ। বিপুল মুসল্লির অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এ জামাতের জন্য রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বরাবরের মতো এবারও ‘শোলাকিয়া স্পেশাল’ নামে দুটি বিশেষ ট্রেন চালু করেছে।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শোলাকিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিনাজপুরের গোর-এ-শহীদ বড় ময়দান ঈদের জামাতে অন্যতম বৃহৎ জমায়েত হয়ে উঠেছে। আয়োজকদের দাবি, প্রায় ২২ একর আয়তনের এ মাঠে একসঙ্গে পাঁচ থেকে ছয় লাখ মুসল্লি ঈদের নামাজ আদায় করতে পারেন। আজ সকাল সাড়ে ৮টায় অনুষ্ঠিতব্য জামাতে ইমামতি করবেন মাওলানা মো. মাহফুজুর রহমান।
কোরবানি: ত্যাগের প্রতীক
আজকের দিনের প্রধান ধর্মীয় দায়িত্ব হলো কোরবানি। যারা সামর্থ্যবান, তারা আল্লাহর নামে গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া কিংবা উট কোরবানি দেন। এই কোরবানির মাংস তিনভাগে ভাগ করা হয়—এক ভাগ নিজেদের জন্য, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনের জন্য এবং এক ভাগ গরিব-দুস্থদের জন্য। ইসলাম শিক্ষা দেয়, ‘‘নিজে খেয়ে পরিপূর্ণ হলেও তোমার প্রতিবেশি যদি ক্ষুধার্ত থাকে, তবে তা আল্লাহর অপছন্দনীয়।’’
এ জন্যই ঈদের দিনে কোরবানির মাংস বিতরণে ধনীদের মধ্যে দেখা যায় আন্তরিকতা ও সহানুভূতির প্রবল বহিঃপ্রকাশ। যারা কোরবানি দিতে পারেননি, তাদের ঘরেও পৌঁছে যায় আনন্দের ছোঁয়া।
এই ধর্মীয় রীতিটি মুসলমানদের মধ্যে সাম্য, সহমর্মিতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধকে বাড়িয়ে তোলে। শুধু আত্মতুষ্টির জন্য নয়, বরং সমাজের সবাই যেন ঈদের আনন্দে অংশ নিতে পারে—এই উদ্দেশ্যেই ইসলামে কোরবানি গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা হয়েছে।
জাতীয় আয়োজন
ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তাঁদের বাণীতে উঠে এসেছে ত্যাগ, সহমর্মিতা এবং শান্তি-সম্প্রীতির বার্তা।
রাষ্ট্রীয়ভাবে সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবন সজ্জিত হয়েছে আলোকসজ্জায়। জাতীয় সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করেছে ঈদ সংখ্যা, যাতে রয়েছে গল্প, কবিতা, ঈদবাজারের চিত্র, রম্য রচনা ও বিশেষ প্রতিবেদন।
বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার এবং বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রচার করছে ঈদ উপলক্ষে নির্মিত বিশেষ নাটক, টেলিফিল্ম, সংগীতানুষ্ঠান ও রম্য অনুষ্ঠানের সমাহার।
সরকারিভাবে হাসপাতাল, কারাগার, এতিমখানা, শিশু সদন এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পরিবেশন করা হচ্ছে উন্নতমানের খাবার। এসব আয়োজন দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে ঈদের আনন্দে একসূত্রে বেঁধে ফেলছে।
নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রস্তুত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী
রাজধানীসহ দেশের সব শহরে ঈদের জামাত ও কোরবানির কার্যক্রম নির্বিঘ্ন রাখতে র্যাব, পুলিশ, আনসার ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ ঈদগাহ, পশুর হাট এবং কোরবানির স্থানে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ত্যাগ, আত্মশুদ্ধি, সহমর্মিতা ও সামাজিক দায়িত্ব পালনের শিক্ষা নিয়ে আবার এসেছে ঈদুল আজহা। ঈদের এই মহাসম্মিলনে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে পথচলার এই দিনটিতে ইসলামের মহান শিক্ষা হোক আমাদের প্রতিদিনের জীবনে বাস্তবায়নের অনুপ্রেরণা।
বাংলাবার্তার পক্ষ থেকে সবাইকে ঈদ মোবারক!
বাংলাবার্তা/এমএইচ