
ছবি: সংগৃহীত
সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত বিশ্বের বৃহত্তম বার্ষিক ধর্মীয় সমাবেশ—হজ—আগামী ২৫ বছর আর গ্রীষ্মকালীন তাপদাহের মাঝে অনুষ্ঠিত হবে না। সম্প্রতি সৌদি আরবের জাতীয় আবহাওয়া কেন্দ্র (NCM) এক ঘোষণা দিয়ে জানিয়েছে, চাঁদের গতিপথ অনুযায়ী হিজরি সন অনুসারে সময় এগিয়ে যাওয়ার ফলে হজের সময় আগামী কয়েক দশকে ধীরে ধীরে বসন্ত, শীত ও শরতের মতো অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা ঋতুতে চলে আসছে। এই ধারা অব্যাহত থাকবে ২০৫০ সাল পর্যন্ত, যখন পুনরায় হজ গ্রীষ্মকালে অনুষ্ঠিত হবে।
এই বিষয়ে এনসিএম-এর মুখপাত্র হুসেইন আল কাতানি গালফ নিউজকে বলেন, "২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত হজ ছিল গ্রীষ্মকালীন আবহাওয়ায় শেষ হজ। এখন থেকে হজ ধীরে ধীরে ঠান্ডা ঋতুতে সরে যাবে। পরবর্তী আট বছর হজ হবে বসন্তে, তারপর আট বছর শীতে এবং এরপরে আট বছর শরতে। এর ফলে প্রায় ২৫ বছর ধরে হজ পালনকারীরা আর গরমে কষ্ট পাবেন না।"
হজ ইসলাম ধর্মের পঞ্চ স্তম্ভের অন্যতম একটি, যা প্রতি বছর হিজরি বর্ষের ৮ থেকে ১৩ জিলহজ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। হিজরি পঞ্জিকা সৌর বর্ষের পরিবর্তে চন্দ্র বছরের উপর ভিত্তি করে চলে, যার কারণে হিজরি সন প্রতি বছর গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির চেয়ে প্রায় ১১ দিন এগিয়ে আসে। এই পরিবর্তনের ধারায় প্রতিবছর হজের সময়ও একটু একটু করে আগে চলে আসে, ফলে একসময় তা বিভিন্ন ঋতুর মধ্যে পড়ে।
এই প্রক্রিয়ার ফলে হজের সময় এক পূর্ণ চক্রে ৩৩ বছর পর আবার একই মৌসুমে ফিরে আসে। বর্তমানে এই চক্র অনুযায়ী হজ ধীরে ধীরে গ্রীষ্মকাল থেকে সরে এসে ঠান্ডা সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যা হজযাত্রীদের জন্য এক বড় স্বস্তির সংবাদ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এনসিএম-এর প্রকাশিত হজের সময়সূচি (২০২৬-২০৫০)
২০২৬ থেকে ২০৩৩ সাল: হজ হবে বসন্তকালে (মার্চ থেকে মে)
২০৩৪ থেকে ২০৪১ সাল: হজ অনুষ্ঠিত হবে শীতকালে (ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি)
২০৪২ থেকে ২০৪৯ সাল: হজ পড়বে শরতে (সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর)
২০৫০ সাল: হজ আবার গ্রীষ্মকালে ফিরবে, তারিখ পড়বে আগস্টে
এই সূচি অনুযায়ী ভবিষ্যতের হজ মৌসুমগুলোর তারিখ চিহ্নিত করে একটি বিস্তারিত ক্যালেন্ডারও প্রকাশ করেছে সৌদি আবহাওয়া বিভাগ, যেখানে হিজরি সনের তারিখগুলোকে গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির সাথে মেলানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ঋতুভিত্তিক পরিবর্তন হজযাত্রীদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সৌদি আরবের মক্কায় সমবেত হন হজ পালনের জন্য। গ্রীষ্মকালে মধ্যপ্রাচ্যের প্রচণ্ড গরম, যা কখনও কখনও ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়, হজ পালনকারীদের জন্য কঠিন শারীরিক পরীক্ষার মতো হয়ে দাঁড়ায়। অতিরিক্ত তাপমাত্রা, পানিশূন্যতা, হিট স্ট্রোক এবং স্বাস্থ্য জটিলতার ঝুঁকি বৃদ্ধির কারণে অনেক সময় জরুরি চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করাও কঠিন হয়ে পড়ে।
বিশেষ করে বয়স্ক হজযাত্রী, যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ বা কিডনি সমস্যার মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগ আছে, তারা গরমকালে হজ করতে গিয়ে অধিক শারীরিক ঝুঁকির মুখে পড়েন। সেই দিক থেকে তুলনামূলক ঠান্ডা ঋতুতে হজ অনুষ্ঠিত হলে শারীরিক চাপ অনেকটাই কমে আসবে এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাস পাবে।
হজ মৌসুমে প্রায় ২০ থেকে ২৫ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মুসলমান অংশগ্রহণ করেন। এত বড় সংখ্যক মানুষের সমাগমে যাতায়াত, থাকার ব্যবস্থা, খাদ্য ও পানির সরবরাহ, নিরাপত্তা, চিকিৎসাসেবা ইত্যাদি বিষয়গুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য আগাম পরিকল্পনা অত্যন্ত জরুরি। গ্রীষ্মের চরম তাপমাত্রা এসব কার্যক্রম পরিচালনায় বাড়তি চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে।
এবারের ঘোষণার ফলে হজের সঙ্গে যুক্ত প্রশাসনিক ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারবে। ঠান্ডা আবহাওয়ায় হজ আয়োজন করলে স্বেচ্ছাসেবক, নিরাপত্তাকর্মী, চিকিৎসাকর্মী এবং বিভিন্ন সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর জন্য কাজ করাও তুলনামূলকভাবে সহজ হবে।
বিশ্বজুড়ে বহু হজযাত্রী এবং তাদের পরিবার নতুন এই সময়সূচিকে স্বাগত জানিয়েছেন। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক মুসলমান হজে অংশ নেন, যাদের অনেকেই বয়স্ক এবং শারীরিকভাবে দুর্বল। অনেকেই বলেন, আগের বছরগুলোতে তীব্র গরমে হজ পালন করতে গিয়ে শ্বাসকষ্ট, হিট স্ট্রোক বা জ্ঞান হারানোর মতো ঘটনা ঘটেছে। তাই তুলনামূলক ঠান্ডা ঋতুতে হজের তারিখ পড়ায় এই সময়টি তাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন থেকেই বিভিন্ন দেশের হজ মিশন এবং হজ অফিসগুলোর উচিত ২৫ বছরের এই ঋতুভিত্তিক ক্যালেন্ডার অনুসারে পরিকল্পনা তৈরি করা। এতে করে ভিসা জারি, বিমান পরিবহন, আবাসন ব্যবস্থা এবং অন্যান্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি গাইডলাইন তৈরি করা সম্ভব হবে।
সৌদি আরব সরকারের পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে, তারা হজ মৌসুম পরিবর্তনের বিষয়টি মাথায় রেখে অবকাঠামো, লজিস্টিক ও প্রযুক্তি সুবিধাসমূহের মান উন্নয়নে আরও বিনিয়োগ করবে।
সার্বিকভাবে বলা যায়, হজের সময়সূচিতে এই আবহাওয়াজনিত পরিবর্তন শুধু হজযাত্রীদের শারীরিক স্বস্তি নয়, বরং প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক সুবিধাও নিশ্চিত করবে। ২০৫০ সাল পর্যন্ত এই ঠান্ডা আবহাওয়ার সুযোগ মুসলিম বিশ্বের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বিশ্রামের সময় হতে চলেছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ